আমি অন্ধকারে নন্দিনীর হাত ধরে তার পাশে বসলাম।
ফতুর? বল ধর্ষিতা হয়েছি। বল নষ্ট হয়েছি। বল নষ্টা নারীকে শেষ পর্যন্ত সকলেই ভোগ করতে চায়; কেউ ভালবাসতে পারে না। সে কারো দয়িতা প্রেমিকা হয় না। তাকে নিয়ে কোনো কবিতা লেখা যায় না।
নন্দিনী…
আমাকে বলতে দাও। তুমি এখনও দ্বিধা ত্যাগ করতে পার নি। আমি জানি তোমার স্ত্রী আছে। আমি না দেখলেও জানি হামিদা বানু সুন্দরী এবং তোমার কাম্য নারী। তাছাড়া তিনি বীরনারী। স্বামী সংসারের চেয়ে দেশকে তিনি সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছেন। একজন বিবাহিত ব্যক্তিকে অন্য নারীর ভালবাসাটা যে নীতিজ্ঞানহীন অপরাধ এটাও আমার অজানা নয় কিন্তু পরিস্থিতি এবং যুদ্ধ আমাদের জন্য কোন্ কোন্ নীতিজ্ঞান এবং মূল্যবোধ অবশিষ্ট রেখেছে তা কী আমাকে বলে দিতে পার? এই কয়দিন আগেও তুমি আমাকে বলেছ তুমি আমাকে ভালবাস। বল, বল নি?
কিন্তু আমাদের পরস্পরের ভালবাসা সামাজিক আপত্তিকে প্রতিরোধ করতে পারে না, নন্দিনী এখনও তোমাকে অকপটে বলছি তোমাকে ভালবাসি। আমার অন্তর থেকে ভালবাসি। আমার এটুকুই অপরাধ, সমাজের কাছে, আত্মীয়স্বজনদের কাছে। আমার স্ত্রী আছে। তাকেও আমি ভালবাসি। গভীরভাবে ভালবাসি। অথচ এই দুটি ভালবাসাকে একসাথে মেলাবার আমাদের আধুনিক জীবনে কোনো যুক্তি নেই। আমি যত সমকালীন সাহিত্য কাব্য উপন্যাস পড়ি সেখানে দুটি নারীকে একসাথে ভালবেসে একসাথে ঘর করার কোনো দৃষ্টান্ত পাই না। যেটুকু আছে তা ধর্মীয় দৃষ্টান্ত। সম্ভবত এ দৃষ্টান্ত তোমার তেমন ভালো লাগবে না নন্দিনী। কারণ তুমি মুসলমান নও। আমি তোমাকে তা হতেও বলতে পারি না। আর তুমি মুসলমান হলেই যে সমস্যার সমাধান হয়ে গেল এটাও ভাবা যায় না। হামিদাই বা তা মানবে কেন? আমার মনে হয় হামিদা নিজেকে বিনাশ করে ফেলতেও দ্বিধা করবে না। তবুও এ পরিস্থিতি মেনে নিতে রাজি হবে না।
কেন হবেন না, বৌদি কী মুসলমান নন?
মুসলমান। তবে আমরা সবাই কী পাশ্চাত্য মূল্যবোধের বাইরে যেতে পারি?
তোমাদের ধর্ম যদি আমার জন্যে একটু আশ্রয় রেখে থাকে তাহলে আমার মতো ভিখিরির প্রতি তার মমতা হতেও পারে? আগে থেকেই তুমি তো বলতে পার না কবি?
এমনভাবে নন্দিনী কথা বলল আমি বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে গেলাম। আমি বললাম, নন্দিনী বাতিটা জ্বালিয়ে দিই?
থাক না। বললাম তো এখন আলোতে আমরা আমাদের দুজনকে খোলামেলা দেখতে পেলে কথা এগোবে না। আমি কিছু বিষয় নিয়ে তোমার সাথে একটু একান্তে আলাপ করতে চাই। কবি সত্যি কী তুমি আমাকে ভালবাস? না আমি নিরুপায় বলে আমার প্রতি করুণা করছ?
নন্দিনী!
থাক, বলতে হবে না। আমিই বলছি শোন। আমি জানি তুমি আমাকে ভালবাস। এই ভালবাসা সৃষ্টি হয়েছে আমার সামান্য রূপ, আমার নিরুপায় অবস্থা এবং একটা দীর্ঘ সময়ের মেলামেশা ও একই সাথে দুঃখ বরণের মধ্য দিয়ে। রূপকে সামান্য বললেও আমার রূপ অর্থাৎ দেহের মোহও প্রকৃতপক্ষে তোমার কবি মনে নেশা ধরিয়ে দিয়েছে। তুমি আমার দেহটাকে পেতে চাও। এর ফলে তোমার সংসার এবং আত্মীয়স্বজনের সাথে সম্পর্ক ভেঙে যেতে পারে বলে মনে কর। প্রথম ভেবেছিলে যাই ঘটুক, আমাকে তোমার চাই। কিন্তু এখন, আমার সাময়িক অনুপস্থিতি, হামিদা বৌদির বীরত্বপূর্ণ আত্মত্যাগের সংকল্প সব ঘটনা তালগোল পাকিয়ে গেছে। এখন তুমি ভাবছ, হামিদাকে তুমি ত্যাগ করে আমাকে স্ত্রী রুপে গ্রহণ করতে পার না। কারণ তোমার বিবেক বলছে এ এক গুরুতর অন্যায়। ঠিক কিনা?
আমি কোনো জবাব না দিয়ে চুপ করে থাকলাম।
আমার কথার জবাব দিতে চাও না?
তুমি তো বললে আমার কিছু বলতে হবে না। যা বলার তুমিই বলবে।
হাঁ। আমিই বলব।
বলে যাও আমি শুনছি।
শোনো। প্রেম বা পুরুষ সম্বন্ধে তোমার সাথে সাক্ষাতের আগে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। তাছাড়া ধর্মের ব্যাপারে আমার পরিবার পরিজন এবং আমি নিজে ছিলাম অত্যন্ত গোঁড়া। আমাদের গাঁয়ের মুসলমান প্রতিবেশীদের সাথে আমরা প্রকাশ্যে সম্প্রীতির ভাব দেখালেও মনে প্রাণে ঘৃণা করতাম। পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতি আমাদের সম্প্রদায়ের সামান্যতম কোনো আনুগত্য বা ভালবাসা ছিল না। আমাদের আনুগত্য ছিল ভারতের প্রতি। সবদেশে সব সংখ্যালঘুদের মনোভাব একই রকম। আমরা সব সময় ভাবতাম একদিন না একদিন ভারত এসে পূর্ব পাকিস্তান দখল করে নেবে। আমার নিজের দেশটা একদিন ভারতের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাবে। আমার সম্প্রদায়ের অর্থাৎ হিন্দুদের সেই সময় পর্যন্ত শুধু ধৈর্য ধরে থাকতে হবে। এই প্রতীক্ষার মধ্যেই আওয়ামী লীগ ছ’দফার দাবি তুললে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিটি হিন্দুর হৃদয়ে আনন্দের হিল্লোল বয়ে যায়। হিন্দু মাত্রই ছ’দফার সমর্থক ছিল। কিন্তু এ ধারণা কারুরই ছিল না পূর্ব বাংলার মুসলমানরা বৃটিশ আমলের হিন্দু জমিদার শ্রেণীর দ্বারা নিষ্পেষিত হলেও শিক্ষাদীক্ষা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যবসা বাণিজ্যে অনেকদূর পর্যন্ত এগিয়ে এসেছে আর সংস্কৃতি ক্ষেত্রে এমন এক অদ্ভুত জাতীয়তাবাদের উন্মাদনা সৃষ্টি করতে যাচ্ছে যা পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু এবং পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুদের সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি বা আকাঙ্ক্ষার সাথে মেলে না। উনসত্তরের গণ আন্দোলনের সময়ই পূর্ব বাংলার ভারতমুখী সাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল হিন্দুরা বুঝতে পারে ছ’দফার আন্দোলনকারী জাতীয়তাবাদী মুসলমানরা এমন এক আন্দোলনের সূচনা করতে যাচ্ছে যা পাঞ্জাবি ঔপনিবেশিক ধ্যানধারণা শোষণতন্ত্র এবং উর্দুভাষীদের প্রাধান্যকে খর্ব করবেই। আবার অন্যদিকে ভারতেও মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এ সময় আমি পত্রপত্রিকায় তোমার রচনার সাথে পরিচিত হই। তোমার কবিতা আমার হৃদয়মনকে এমনভাবে নাড়া দেয় যে আমার মধ্যে মুসলমানদের প্রতি যে গোপন ঘৃণার ভাব ছিল তা দূর হতে থাকে। আমি সীমাদির স্বামীকে ঢাকা থেকে তোমার কবিতার বই কিনে আনতে পীড়াপীড়ি করতাম এবং নিজেও একটু আধটু লিখতে চেষ্টা করতাম। তুমিই ছিলে আমার প্রিয় কবি। বিশ্বাস কর, তোমাকে এক নজর না দেখেই আমি তোমার ভক্ত ও আবেগের বশীভূত হয়ে যাই। ভেব না দেশ থেকে পালিয়ে আসার সময় এবং বিপদমুহূর্তে তোমার পরিচয় পেয়েই আমি তোমার প্রেমে পড়েছি। তবে তোমার তখনকার সাহস এবং দুটি অসহায় নারীর প্রতি দয়া ও কর্তব্যবোধ দেখে তোমার কবিতার চেয়েও তোমাকে ভালবেসেছি বেশি।