আমার একদম ঘুম পাচ্ছিল না। অনেক চেষ্টা করেও চোখের পাতা এক করতে পারছিলাম না। চোখ বুজলেই হামিদার যন্ত্রণাকাতর মুখ ভেসে উঠছিল। অনেকক্ষণ নন্দিনীর জন্য অপেক্ষা করে আমি দুয়ার খুলে বাইরে এলাম। সারাটা ফ্ল্যাটে বাতি নিভানো। শুধু একটা টয়লেটের ভেতরে বাতি জ্বলছে। টয়লেটের ভেতর থেকে কে বেরুবে কিছুই আন্দাজ করতে না পেরে আমি একটা থামের আড়ালে অপেক্ষা করতে লাগলাম। একটু পরেই মুখে পানি ছিটিয়ে নন্দিনীকে বেরুতে দেখে আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম নন্দিনী নিজের ইচ্ছেয় আমার কামরায় ঢুকে কিনা। কিন্তু আমার ধারণা সঠিক হয় না। নন্দিনী বারান্দার বাতি জ্বালিয়ে বেসিনের ওপরের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তার শাড়ি ঠিক করে টাওয়েলে হাতমুখ মুছে মিতুর ঘরের দিকে হেঁটে যেতে লাগল। একেবারে মিতুর দরজার কাছে চলে গেলে আমি খুব আস্তে তার নাম ধরে ডাকলাম। নন্দিনী আমার দিকে না ফিরেই চুপচাপ দরজার কড়া ধরে দাঁড়িয়ে রইল।
ঘুম আসছে না। এসে একটু কথা বল নন্দিনী।
আমার কথায় নন্দিনী একটু নড়ছে না দেখে নিজেই এক পা এক পা করে কাছে এসে তার হাত ধরলাম।
তোমার কী হয়েছে নন্দিনী?
কই কিছু হয় নি তো।
হঠাৎ আমাকে এড়িয়ে চলছ বলে মনে হচ্ছে। আমার কোনো কথায় বা আচরণে কী তুমি দুঃখ পেয়েছে?
না কবি। তোমাকে এড়িয়ে চলার শক্তি আমার নেই। আমি চেষ্টা করছি সমাজের চোখে যা অপরাধ, পাপ সেটার হাত থেকে তোমার মতো সরল মানুষকে বাঁচাতে। তুমি আমার সহায় না হলে মনে হচ্ছে পারব না।
বলেই নন্দিনী দুহাতে আমার গলা জড়িয়ে ধরে একটা বাচ্চা মেয়ের মতো ফুঁপিয়ে উঠল।
আমি নন্দিনীর ফুঁপিয়ে ওঠা কান্নাকে নিজের হৃদয়ের ভেতর উথলে ওঠার সংক্রাম অনুভব করে তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললাম, কেঁদো না নন্দিনী। আমি কথা দিচ্ছি, তোমার সহায়তা করব। লোকেরা তোমাকে আমাকে জড়িয়ে নানা কথা রটনা করার সুযোগ পাবে আমি সেটা কেন হতে দেব? আমার ঘরে যখন তখন আমি আর তোমাকে ডেকে নেব না। তুমি এখন মিতুর সাথে গিয়ে শুয়ে পড়। আমি তোমাকে ডেকে সত্যি ভুল করেছি। আমাকে ছাড়, আমিও গিয়ে ঘুমোবার চেষ্টা করি।
আমার কথায় নন্দিনী আরও জোরে আমাকে জড়িয়ে ধরে বেশ বিলাপ করে কাঁদতে লাগল, আমি তোমাকে ভালবাসি কবি। আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না। এ জগতে তুমি ছাড়া আমার কেউ নেই।
আমি দিশেহারার মতো নন্দিনীর রোদনরত কম্পিত দেহকে বুকের ওপর রেখে একবার পারুলের ঘরের দিকে তাকালাম। না, সেখানে কোনো আলো নেই। মিতুর ঘুমের মৃদু আওয়াজ পাচ্ছি ঘরের ভেতর থেকে। এ ঘরের ভিতরে বোধ হয় একটা ঢাকা দেয়া টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে।
আমি বললাম, আমাদের এভাবে কেউ দেখতে পাবে নন্দিনী।
আমার কথায় নন্দিনী কান্না থামাল। কিন্তু আমার গলা জড়িয়ে ধরে রাখা হাত দুটি সরাল না। আমিও তা জোর করে এখন সরিয়ে দিতে পারছি না। এক অদ্ভুত অনুভূতি এবং বিহ্বলতা নিয়ে আমরা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা যায় এই বিব্রতকর চিন্তা আসতেই নন্দিনী আমার গলা থেকে হাত নামিয়ে নিয়ে বলল, চল তোমার ঘরে গিয়ে একটুখন বসব।
আমি কোনো জবাব না দিয়ে নন্দিনীর পেছন পেছন আমার ঘরে এসে ঢুকলাম। আমরা উভয়ে ঘরে ঢোকা মাত্রই নন্দিনী ফিরে দাঁড়িয়ে ঘরের দুয়ার বন্ধ করে ছিটকিনি এঁটে দিয়ে বাতি নিভিয়ে দিল। কামরায় ভেতরকার নিকষ অন্ধকারে আমরা পরস্পরকে দেখতে পাচ্ছি না। আমি অন্ধের মতো আন্দাজে আমার বিছানাটা স্পর্শ করতে এগোলে নন্দিনীর গায়ে হাত ঠেকল। নন্দিনী আমার হাতটা ধরে টানল, আমার পাশে বস কবি।
আমি বললাম, বাতি নেভালে কেন?
আলোকে ভয় লাগে।
অথচ একটু আগেই তুমি পাপ পুণ্যের কথা, লোক নিন্দার কথা বলছিলে। সমাজের চোখে যেটা মন্দ সেটার হাত থেকে আত্মরক্ষার ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করতে মিনতি করেছিলে। এখন হঠাৎ কী হল নন্দিনী?
কিছুই হয় নি। আমি সমাজকে লোকনিন্দাকে মিথ্যে ভয় পেয়েছিলাম।
না নন্দিনী। তুমি ঠিক কথাই বলেছিলে। বরং আমিই ছিলাম লোভী। একটু আগে আমিই ভুলে গিয়েছিলাম আমি নিজের দেশ ছেড়ে কেন এখানে এসেছি। ভুলে গিয়েছিলাম আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। মাত্র কয়েকদিন আগে শত্রুদের সাথে সামনাসামনি একটা মারাত্মক যুদ্ধ থেকে ফিরে এসেছি। যেখানে কমরেড রেজার প্রাণপ্রিয় সহকর্মীরা ফ্রন্টাল ফাঁইটে বীরের মতো প্রাণ দিয়েছে। নাসরিনের মতো একটা কিশোরী মেয়ের ওপর এক রকম আমাদের নাকের ডগায় বলাৎকার হয়েছে। মেয়েটির মানসিক ভারসম্য নষ্ট হওয়ার উপক্রম হওয়ার তার চিকিৎসার জন্য আমি দ্বিতীয়বার কলকাতায় এসেছি। এসেই শুনেছি আমার মুক্তিযোদ্ধা স্ত্রী একটা অপারেশনে গিয়ে পঙ্গু হয়ে বিনা চিকিৎসায় বিপদের মধ্যে পড়ে তড়পাচ্ছে। আমি তার সাহায্যের জন্য ঢাকায় যাচ্ছি। মুহূর্তের লোভে আমি সব ভুলে যাই নন্দিনী। বরং আজ একটু আগে তোমার সামান্য প্রত্যাখ্যানে আমি আমার আসল চেহারাটা উপলদ্ধি করে খুব ভয় পেয়েছি। মনে হয়েছে তোমার অসহায় অবস্থার সুযোগ নিয়েছি আমি। যারা তোমাকে ট্রেনিং ক্যাম্পে অপমানের চেষ্টা করেছিল আমি তাদের চেয়ে কোনো অংশেই ভালো নই। আমাকে তুমি ক্ষমা কর নন্দিনী। এখন থেকে তোমার মর্যাদার কথা আমি মুহূর্তের জন্যও ভুলব না। মুক্তিযুদ্ধে তুমি যেভাবে ফতুর হলে তা আমার চেয়ে কে বেশি জানে?