নাসরিন আমার দিকে ফিরে একটু হাসার চেষ্টা করল। আমিও। রেজা ভাই নাসরিনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, তোমার আব্বা আম্মার খবর নিতে পারি নি। তবে আমাদের লোক কোনো না কোনোভাবে তাদের একথা জানিয়ে দেবে তুমি বিপদ থেকে রক্ষা পেয়ে আমার সাথে কলকাতায় নিরপদেই আছ।
নাসরিন খুব বাধ্য মেয়ের মতো কমরেড রেজার কথায় সায় দিয়ে মাথা নাড়ল। পারুল এগিয়ে গিয়ে নাসরিনের হাত হাতে তুলে নিয়ে আশ্বাস দিয়ে বলল, আমি সকাল সন্ধ্যায় তোমাকে দেখে যাব। রিলিজ হলে আমার কাছে নিয়ে যাব। কোনো টেনশনের মধ্যে থেক না।
না কিছু ভাবব না।
বেশ দৃঢ়তার সাথে বলল নাসরিন। বুঝলাম নাসরিন সবকিছু কাটিয়ে উঠে আবার দর্শনার কাষ্টম কলোনীতে প্রথম দেখা মেয়েটির মতোই সাহসী হয়ে উঠেছে। আমি ডাক্তার অজয় রায়ের দিকে ফিরে বললাম, আপনি অসাধ্য সাধন করেছেন ডাক্তার। আপনার কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
ডাক্তার হাসলেন, চলুন আমার কামরায় গিয়ে একটু চা খাবেন সবাই।
আমরা ক্লিনিক থেকে হেঁটে বাসায় ফেরার পথে কমরেড আলী রেজা পারুলকে বলল, আমি এখন আর বাসায় ফিরছি না। আজ রাতেও সম্ভবত ফেরা হবে না।
পারুল বলল, আমাদের বাসায় কিন্তু আপনার থাকার কোনো অসুবিধে হবে না রেজা ভাই।
আমি সেটা জানি বোন। তবে দেশের ভিতরে যাওয়ার আগে স্থানীয় কয়েকজন রাজনৈতিক নেতার সাথে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে একটু আলাপ করে যেতে চাই। আমার ধারণা এ যুদ্ধ আর বেশি দূর এগোবে না। এর আগেই, এই দুচার দিনের মধ্যেই মিসেস গান্ধী বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর চেয়েও মারাত্মক এক দখলদার বাহিনী নামিয়ে দেবে। আর তোমাদের যুদ্ধের ইতি এখানেই। তোমাদের বিজয় মিছিল যখন পথে বেরুবে তখন আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশের গ্রামে গঞ্জে অন্য একটা মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য ফিরে যাবে। এটাই ঘটবে। তোমার কাছে অনুরোধ তুমি শুধু আমাদের নাসরিনটাকে একটু নিজের আশ্রয়ে রেখ।
আমি প্রতিবাদ করে বললাম, আপনার ধারণাতো ঠিক নাও হতে পারে রেজা ভাই। সারা পৃথিবী আমাদের স্বাধীনতার পক্ষে। পাকিস্তানের বদলে ভারত দখলদার সাজবে বিশ্বের মানুষ তা মানবে না। আমরাও অস্ত্র ত্যাগ করব না।
এটা কবির মতো কথা বটে। দেখা যাক, আপনার ধারণাই সত্য হোক। তবে আমি তো কবি নই হাদী সাহেব। গত চৌদ্দ বছর ধরে সাম্রাজ্যবাদ উপনিবেশবাদ ও সম্প্রসারণবাদের সাথে লড়াই করে চলেছি। মুখ কোনটা মুখোশ কোনটা তা এখন ধরতে পারি। আচ্ছা আপনারা বাসায় যান। আমি অন্য পথে যাব।
আপনার নিরাপত্তার ব্যাপারে একটু সাবধান থাকবেন রেজা ভাই।
আমার কথায় রেজা ভাই একটু হাসলেন। তারপর সোজা আমরা যেদিক থেকে আসছিলাম আবার সেদিকেই দ্রুত হন হন করে হেঁটে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আমি, নন্দিনী ও পারুল কতক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম।
১১. রাতে খাওয়ার টেবিলে
রাতে খাওয়ার টেবিলে নন্দিনী ইমামকে হঠাৎ এক আচমকা প্রশ্ন করে বসল, আমাদের সমর্থনের অছিলায় ভারতীয় বাহিনী কী বাংলাদেশ দখল করবে?
ইমাম অনেকক্ষণ এ কথার জবাব না দিয়ে চুপ করে বসে থাকল। তারপর খুব শান্ত গলায় বলল, আক্রমণ বা দখল নয়। সাহায্যের জন্য এগিয়ে যেতে পারে। তাদের সাহায্যেই যখন আমরা পাক হানাদারদের সাথে লড়ছি।
দেশের ভেতরে এখন প্রতিটি গ্রামে গ্রামে লড়াই চলছে। খান সেনারা মার খেয়ে ক্যান্টনমেন্টগুলোর দিকে সরে যাচ্ছে। বলতে গেলে সারা গ্রামবাংলা এখন ফ্রি জোন। এ অবস্থায় ভারতীয় বাহিনীকে আপনারা আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন?
আমরা আমন্ত্রণ জানাচ্ছি এটা ঠিক নয়। ভারত ভাবছে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা নিয়ন্ত্রণের বাইরে থেকে এভাবে প্রতিরোধ চালিয়ে গেলে তাদের আসামে মেঘালয়-এমন কী পশ্চিমবঙ্গেও এ যুদ্ধ ছড়িয়ে যাবে। পরিণামে ভারতের সমগ্র পূর্বাঞ্চলে নকশালপন্থীরা প্রভাব বিস্তার করবে। আর পরাজিত পাকিস্তানীরা তাদের সমস্ত আর্মস এমনেশন তুলে দেবে নকশালদের হাতে। তখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ পরিণত হবে পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নবাদীদের লড়াইয়ে। ভারত এটা হতে দেবে কেন?
ইমামের কথার জবাবে আমি বললাম, কিন্তু ভারত যদি বাংলাদেশে ঢুকে বেরুতে না চায়?
আমরা মনে করি ভারতের এখন সে পরিস্থিতি নেই। তারা তাড়াতাড়ি যুদ্ধটার একটা সমাপ্তি চায়। মুক্তিযোদ্ধাদের দেশের ভেতরকার নিয়ন্ত্রণ এখন কারো হাতে নেই। তাদের হাতে অস্ত্র থাকতে ভারত তেমন ভুল করতে পারে না। ভারত চায় না বাংলাদেশের মাটিকে চীনপন্থীদের গেরিলা তৎপরতার উর্বর ক্ষেত্র বানাতে। শেখ সাহেব যদি পাকিস্তানের কারাগার থেকে জ্যান্ত ফিরতে না পারেন তবে এ যুদ্ধ, এ আন্দোলনের নেতৃত্ব চলে যাবে মাওলানা ভাসানীর হাতে। তখন ভারত যা আশংকা করছে তাই ঘটবে।
এবার নন্দিনীর দিকে হেসে মুখ তুলল ইমাম।
আমি বললাম, এ জন্যই কী মাওলানাকে নজরবন্দি রাখা হয়েছে?
এ বিসয়ে মন্তব্য করা আমার পক্ষে অনুচিত হবে।
বলেই ইমাম তার প্লেটের ভেতর পানি ঢেলে উঠে গেলেন।
খাওয়ার পর নন্দিনী মিতুর সাথে থাকবে বলে চলে গেলে আমি ডাইনিং টেবিল থেকে সোজা আমার কামরায় এসে শুয়ে পড়লাম। দরজা ভেজিয়ে দিলেও ছিটকিনি তুললাম না। কারণ আমি জানতাম নন্দিনী মিতুকে ঘুম পাড়িয়ে আমার সাথে কথা বলতে আসবে। শুধু পারুলের সামনে চক্ষু লজ্জার খাতিরে সে মিতুর কামরায় গিয়ে শুয়েছে।