বেশ ধীরে সুস্থে কথাগুলো বলে রেজাভাই লোকমা তুলল। ইমাম আমার দিকে ফিরে বলল, দিদিকে আপনাদের সাথে নিন ভাই। নাসরিন না হয় আমাদের সাথে থাকবে।
তাহলে তো আমি খুবই নিশ্চিন্ত হয়ে রওনা দিতে পারি।
বললেন আলী রেজা।
পারুল আমার পাতে কোর্মার ঝোল তুলে দিতে দিতে বলল, দিদির এখন, এই মুহূর্তে ঢাকায় যাওয়া কী ঠিক হবে? যেখানে ভাবিকে নিরাপদ জায়গায় সরাতে আপনাদেরই মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে থাকতে হতে পারে?
তুমি আর না বল না পারুল। আমি আসলে বৌদির কাছেই যেতে চাইছি। আমি তার কাছে থাকব। তার সেবাযত্ন করব। আমাকে পেয়ে বৌদি তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যাবেন। আমি না গেলে তার উদ্বেগ দূর হবে না। এটা আমি জানি।
বেশ দৃঢ়তার সাথে কথা বলছে নন্দিনী।
ইমাম বলল, মন্দ বলেন নি। আমি আপনাদের ঢাকার উপকণ্ঠে পৌঁছে দেয়ার মোটামুটি নিরাপদ একটা ব্যবস্থা নিতে পারি। কয়েকজন সশস্ত্র লোক আপনাদের সাথে দিতে পারি।
না, এ ব্যাপারে আপনাকে কিছু করতে হবে না। বরং ভেতরে এখনও আমার কয়েকটা ঘাঁটি আছে। ঢাকা পর্যন্ত এদের নিয়ে যেতে আমার কোনো অসুবিধেই হবে না। আমরা এক ঘাঁটি থেকে অন্য ঘাঁটিতে বিশ্রাম নিয়ে এগোব। ভাগ্য ভালো থাকলে যানবাহনও পেয়ে যেতে পারি।
ঢাকায় যাওয়ার ব্যাপারে ইমামের সাহায্য নিতে অস্বীকার করলেন আলী রেজা। সম্ভবত এর কোনো একটা রাজনৈতিক দিক থাকতে পারে ভেবে আমিও আর কথা বাড়ালাম না। শুধু মিতু ছেলে মানুষের মতো আমাকে জিজ্ঞেস করল, মামা, আমরা আর কতদিন পরে ঢাকায় ফিরতে পারব?
রেজাভাই হেসে বললেন, কেন মা কলকাতা তোমার ভালো লাগছে না?
না চাচা। একদম না।
তোমার মতো আমারও। সে জন্যেই তো একটু আগে চলে যেতে চাই। কিছুদিন অপেক্ষা কর, আব্বা আম্মাকে সাথে নিয়ে তুমিও চলে আসবে।
মিতুকে এমনভাবে আশ্বাস দিলেন রেজাভাই মনে হল তিনি এ বিষয়ে নিশ্চিত।
.
খাওয়ার পর বিশ্রাম না নিয়েই আমরা রোজ ক্লিনিকের দিকে রওনা হলাম। বাসায় থাকল ইমাম আর মিতু। ক্লিনিকে পৌঁছেই ডাঃ রায়ের ঘরে গেলে তিনি সাদরে আমাদের বসতে বলে বেল টিপলেন। একজন নার্স মুহূর্তের মধ্যে দরজায় এসে দাঁড়ালে তিনি বললেন, সাত নং কেবিনের রোগিনীর চার্টটা দেখে আসুন।
একটু আগে দেখেছি স্যার। চমৎকার রিকভারি। গত রাতে খুব ভাল ঘুম হয়েছে। দুস্বপ্ন দেখে কেঁদে ওঠে নি। আমার তো মনে হয় দুদিন এভাবে গেলে রিলিজ করে দেয়া যাবে।
গুড। নাসরিনের গার্জিয়ানরা এসেছেন। এদের ওর কেবিনে নিয়ে যান।
খুশি হয়ে পারুলের দিকে তাকালেন ডাঃ অজয় রায়। আমি ও পারুল তার প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জানিয়ে রেজা ভাইয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলে ডাক্তার রায় নিজেই তার চেম্বার থেকে আমাদের কেবিনে নিয়ে চললেন। আমরা সাত নম্বরে পৌঁছে দেখি নাসরিন তার বেড ছেড়ে একটা চেয়ারে বসে বেডের ওপর পা মেলে দিয়ে খবরের কাগজ পড়ছে। আমাদের দিকে ফিরেই রেজাভাইকে দেখতে পেয়ে একলাফে তার গলা জড়িয়ে ধরে এমনভাবে ফুঁপিয়ে উঠল যে-আমি, পারুল, ডাক্তার ও নার্স দৃশ্যটির মর্ম বুঝে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম।
রেজাভাই ভেজা গলায় বললেন, শান্ত হও মা। এদের ধন্যবাদ দাও। এবার এদের দয়ায় বেঁচে গেলে। ইনি কবি সাহেবের বোন পারুল আর ডাঃ অজয় রায়।
বেশ কিছুক্ষণ নাসরিন কমরেড রেজার গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদল। একটু শান্ত হলে আমি বললাম, নাসরিন আমরা আবার দেশের ভেতরে যাচ্ছি। তুমি সুস্থ হলে আমার এই বোনটি এসে তোমাকে তাদের বাসায় নিয়ে যাবে। রেজাভাই না ফেরা পর্যন্ত তোমাকে কলকাতায় থাকতে হবে। তোমার কোনো অসুবিধে হবে না এবং চিন্তারও কোনো কারণ নেই।
নাসরিন তখনও রেজাভাইয়ের হাত ধরেছিল। আমার কথায় একটু অবাক হয়ে বলল, আপনারা আমাকে এখানে রেখে কেন ভেতর যাবেন? আমি আপনাদের সাথে যেতে পারি না?
তোমার শরীর-স্বাস্থ্য ঠিক হতে আরও বেশ কতদিন লেগে যাবে। আমার ধারণা এই যুদ্ধ বড় জোর আর দিন বিশেক চলবে। আমার এখন ঢাকায় যাওয়া নানা কারণেই দরকার মা। জানতো আমাদের বহু মানুষ এই যুদ্ধে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যারা শহীদ হয়েছে তাদের কথা আমি বলছি না। যারা নানা জায়গায় বাংলাদেশের ভেতরে বাইরে বিভিন্ন পরিস্থিতির শিকার হয়েছে তাদের রক্ষা করতে হবে। পার্টিকে আবার সংগঠিত করতে হবে। তুমি তো আমাদের সব ব্যাপারই জান নাসরিন। তুমি এখানে যাদের সাথে থাকবে তারা খুব ভালো মানুষ। তারা তোমাকে আমার মতোই দেখাশোনা করবে। তাছাড়া কবি সাহেবের স্ত্রী ঢাকার কাছে একটা অপারেশনে মারাত্মকভাবে আহত হয়ে ঢাকায় পড়ে আছেন। তার সেখানে খুব তাড়াতাড়ি যাওয়া দরকার।
আমার স্ত্রী মারাত্মক আহত হয়ে ঢাকায় পড়ে আছেন সম্ভবত রেজা ভাইয়ের একথাটা নাসরিন ঠিকমতো বুঝতে না পেরে নন্দিনীর দিকে মুখ ফিরিয়ে চেয়ে থাকল। সে জানতো নন্দিনীকে দর্শনার কাষ্টম কলোনীতে আমি আমার স্ত্রী বলে পরিচয় দিয়েছিলাম এবং এক বা একাধিক রাত আমরা একসাথে ছিলাম। নাসরিনের মনোভাব বুঝতে পেরে নন্দিনী এগিয়ে এসে তার হাত ধরে মুচকি হাসল, আমাকে ভুল বোঝে না যেন। এ যুদ্ধে জেতার জন্য তোমাকে, আমাকে সবাইকে নানা পরিচয়ে নানাভাবে থাকতে হয়েছে, হবে। এখন ওসব নিয়ে দুর্ভাবনার দরকার নেই। আমিও এদের সাথে ঢাকা যাচ্ছি। আবার আমাদের একদিন নিশ্চয়ই সাক্ষাৎ হবে। তখন আমাকে সব কথা বুঝিয়ে বলব।