লোকটা সামনের দিকে তাকিয়ে সিগ্রেটে ঘন ঘন টান দিতে লাগল। আমি তার দৃষ্টিকে অনুসরণ করতে গিয়ে দেখি মাঠটার পরে গাছপালার ভিতর মানুষের ঘরবাড়ি দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কোনো মানুষজনকে দেখছি না। হয়তো কেউ এখনো ঘুম থেকে জাগে নি। সূর্য তখন গাছপালার ওপর এসেছে। আকাশে গতরাতের মেঘলা ভাব থাকলেও, পূর্বদিকের প্রান্তসীমা পরিচ্ছন্ন থাকায় আকাশের নীলে উঠে আসা সূর্যের বিচ্ছুরণ থেকে রোদ ছিটকে পড়ছে। এ সময় এ অঞ্চলের কোনো গ্রামবাসীরই ঘুমিয়ে থাকার কথা নয়। সম্ভবত এই গোলযোগের সময় সীমান্ত সংলগ্ন গ্রামগুলো এখন জনশূন্য।
লোকটা সিগ্রেট ফেলে দিয়ে আমার সাথে কথা বলা শুরু করল, তোমার লোকদের বল টাকা-পয়সা গয়নাপাত্র কাপড়চোপড় বাসনকোশন যার কাছে যা কিছু আছে আমার সামনে রেখে দিতে। যদি কেউ কিছু লুকানোর ফিকির করে তবে বেটাছেলের মুখের ভেতর নল ঢুকিয়ে গুলী করব। আর মাগীদের ঐ জায়গায় রাইফেল ঢুকিয়ে দেব।
লোকটা নন্দিনীর দিকে অশ্লীল ইঙ্গিত করল।
আমার কণ্ঠ থেকে কথা বেরুবার আগেই দলের নারী-পুরুষ সকলে, রাজাকাররা একটু আগে সকলের গাট্টি-বোঁচকা হাতিয়ে সবকিছু নিয়ে নেয়ার পরও, যা অবশিষ্ট ছিল তা খুলে লোকটার দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। লোকটা তার দলের একটি ছোকরার দিকে কী ইঙ্গিত করতেই ছেলেটা কাঁধের লাল গামছাটি দলপতির কাল বুট জুতা পরা পায়ের দিকে বিছিয়ে দিল। তার ইঙ্গিতে সকলেই যার কাছে যা টাকা-পয়সা ও লুকানো দুএকগাছি সোনারূপোর বালাচুড়ি বা হার ছিল তা নিঃশব্দে রেখে দিল। আমি চোখের ইশারায় সীমাকে তার শেষ সম্বল কিছু থাকলে গামছায় রেখে দিতে বললাম। বিনা বাক্যব্যয়ে সীমা ও নন্দিনী তাদের লুকানো কিছু একশো টাকার নোট ও গয়নার পুটলি গামছায় রেখে দিল।
লোকটা আমার দিকে ফিরে হাসল, তোমার কাছে কিছু নেই? তোমার মাগীগুলোতো বেশ মালদার। নিজের কাছে কিছু লুকিয়ে রাখো নি? থাকলে ভালোয় ভালোয় গামছায় ফেল। পরে কিছু পাওয়া গেলে যা বলেছি তাই করব।
আমার প্যান্টের একটা গুপ্ত পকেটে হাজার দুএক টাকা ছিল। আমি একটু সাহস ও স্বার্থপরতার সাথে জবাব দিলাম, আমার স্ত্রী ও বোনের কাছে যা ছিল তা গামছায় রাখা হয়েছে। হঠাৎ একটা ঘরবাড়ি ফেলে আসা পরিবারের এর বেশি কি থাকে?
লোকটা কোনো কথা না বলে পকেট থেকে আবার সিগ্রেট বের করে ধরাল। ইতরের মত নন্দিনীর দিকে তাকিয়ে হাসল, আসল মালতো এখনও গামছায় পড়ে নি। ও দুটো বিছানায় পড়লেই চলবে।
আমি তার ইতর ইঙ্গিতের প্রতিবাদ করে বললাম, সাবধান, মুখ সামলে কথা বল। ভদ্র মহিলাদের সব কিছু তোমাদের দেওয়া হয়েছে। আমাদের কাছে আর কিছু নেই।
আছে, আছে। এখনও সবচেয়ে দামি জিনিসটাতেই তো হাত পড়ে নি।
অদ্ভুত মুখভঙ্গি করে কথাগুলো বলেই লোকটা আচমকা আমার মুখের ওপর সজোরে একটা ঘুষি মারল। আমি ছিটকে মাটিতে পড়ে গেলাম। মনে হল আমার ওপরের ঠোঁটটায় কেউ বিদ্যুতের শক দিয়ে সারা চোয়ালটাই অবশ করে ফেলেছে। নন্দিনী ও সীমা ছুটে এসে আমাকে ধরতে চাইল। কিন্তু লোকটা সীমার শাড়ির আঁচল ও নন্দিনীর ব্লাউজের পেছন দিকটা এমনভাবে টেনে ধরল যে দুজনই বাধা পেয়ে থমকে দাঁড়াল। উভয়েরই অসংবৃত অবস্থা দেখে লোকটা জোরে হেসে উঠে বাঁ হাতে কায়দা করে টেনে নন্দিনীর গায়ের ব্লাউজটা ছিঁড়ে ফেলল। আর সীমার শাড়ি এমনভাবে টেনে আনতে লাগল যে সীমা ভয়ে ব্যথায় কঁকিয়ে উঠে কোমরের বাঁধন থেকে পরনের শাড়ি ছেড়ে দিতে বাধ্য হল। শুধু কালো একটা সায়াসহ সীমা আব্রু ঢাকতে মাটিতে বসে পড়ল। নন্দিনীর ব্রেসিয়ার পরা থাকলেও সে তার পরনের শাড়িতে গা ঢেকে এগিয়ে গিয়ে সীমাকে জড়িয়ে ধরল। লোকটার হাতে সীমার শাড়ি।
আমার থুতনী বেয়ে রক্ত বেরিয়ে এলেও আমি একবার উঠে দাঁড়াতেই চেষ্টা করলাম। কিন্তু লোকটার সাথে ছেলেগুলো আমার ওপর লাফিয়ে পড়ে আমার মাথাটা মাটিতে ঠেসে ধরল। লোকটা সীমার শাড়ি আমার পিঠের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে বলল, বাঁধ।
লোকগুলো শাড়িটা মুহূর্তের মধ্যে পাকিয়ে দড়ি বানিয়ে আমাকে পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলল। আমাদের সাথের লোকগুলো ভয়ে কবুতরের মত কাঁপছিল। ভয়ের চোটে কারো মুখ দিয়ে কান্নার শব্দ পর্যন্ত বেরুচ্ছে না। দলের নারী-পুরুষ ঘটনার আকস্মিকতায় অসাড় নিস্পন্দ। লোকটা নন্দিনীর দিকে ফিরে বলল, তোমার শাড়িটাও লাগবে। তুমি খুলে দেবে না আমার লোকেরা খুলবে? পুরো নেংটো হতে হবে না পেটিকোট তো আছে।
নন্দিনী এতক্ষণ সীমাকে জড়িয়ে ধরে বিহ্বল হয়ে বসেছিল। লোকটার কথায় উঠে দাঁড়িয়ে শাড়িটা খুলতে লাগল।
লোকটা জোরে হেসে উঠল, দারুণ।
কাঁধ থেকে রাইফেলটা খুলে তার পাশের স্যাঙাতকে দিল। আর নিজে কোমরের বেল্ট থেকে টেনে বের করল পিস্তল। পিস্তলটা আমাদের দলের অন্যান্য নরনারীর শিশুর দিকে তাক করে চেঁচিয়ে বলে উঠল, মালাউনের বাচ্চারা, তোদের মাসীর বাড়ির পথ এই দিকে। যেতে চাস তো এই মুহূর্তে দৌড়ে পালা। চোখের পলকে মাঠ পার হবি। পেছনে ফিরে দেখবি অমনি গুলী। পণ্ডিত নেহরুর বেটির ঐটা চাট গিয়ে যা। দৌড়, দৌড়।
আমরা ছাড়া পুরো দলটা দৌড়ুতে শুরু করল। কেউ আমাদের দিকে একবার পেছন ফিরেও তাকাল না। মাঠের মাঝামাঝি গিয়ে শিশুসহ একটা মা মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়তেই বুকের শিশুটিও ছিটকে পড়ল ঘাসে।