আমি বললাম, ভালো লাগত কিনা জানি না। তবে লম্বা বেণীর বদলে তোমার বব দেখে মনে হচ্ছে বেণীঅলা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেই তোমাকে মানাত ভালো।
এখন একেবারেই ভালো লাগছে না বুঝি?
এত উপেক্ষা করার ক্ষমতা কী আমার আছে?
মিথ্যা কথায় আমাকে ভুলিও না তো।
আনন্দ বাজার পত্রিকাটা পাশে সরিয়ে রেখে জবাব দিল নন্দিনী। আমি বিষয়টা অন্যদিকে নিয়ে যাওয়ার আশায় বললাম, আবার কখন বাদুড়িয়ায় ফিরে যাচ্ছ?
আর যাচ্ছি না।
নন্দিনীর কথায় আমি চমকে উঠে জিজ্ঞেস করলাম, কী ব্যাপার?
আমি আর ট্রেনিং ক্যাম্পে ফিরে যাচ্ছি না কবি।
কেন? সব কথা আমাকে খুলে বলল নন্দিনী।
নিজেকে বাঁচিয়ে সেখানে অবস্থান করা অন্তত আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়। সেখানে ভালো লোক নেই একথা আমি বলছি না। তবে এমন লোকও আছে যারা মনে করে ওদের লোভের কাছে আত্মসমর্পণ করাই হল মেয়েদের মুক্তিযুদ্ধ।
বলো কী নন্দিনী?
সর্বত্র কী ঘটছে আমি জানি না। তবে আমি যেখানে ছিলাম সেখানে আমার পক্ষে থাকা সম্ভব নয়। এ যুদ্ধ আলী রেজাদের মতো দেশের ভেতর থেকে পরীক্ষিত লোকদের নিয়ে চালাতে হবে। ভারতের সাহায্যে নয়।
বলল নন্দিনী। বুঝলাম অল্পকালের মধ্যেই নন্দিনীর মনে নিদারুণ বিক্ষোভ দানা বেঁধে উঠেছে। এ সময় তাকে ঘাটানো উচিত হবে না ভেবে আমি অন্য প্রসঙ্গে যেতে চাইলাম। বললাম, ঢাকা থেকে খুব খারাপ খবর এসেছে। দুঃসংবাদ।
দারুণ ঔৎসুক্য নিয়ে নন্দিনী আমার দিকে মুখ তুলে তাকাল।
আমার স্ত্রী গুরুতর আহত হয়ে ঢাকায় আটকা পড়েছে। সম্ভবত দুচার দিনের মধ্যে আমি ও রেজাভাই ঢাকা যাচ্ছি।
আমার মুখে হামিদার দুর্ঘটনার সংবাদ এমন আবেগহীনভাবে উচ্চারিত হতে শুনে নন্দিনী নিস্পলকভাবে আমার মুখের দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল, বৌদির কী হয়েছে?
একটা অপারেশনে গিয়ে মাইনের আঘাতে উরুর হাড় ভেঙে গেছে বলে খবর এসেছে। সে যেখানে আছে জায়গাটাও নিরাপদ নয় যে কোনো মুহূর্তে ধরা পড়ে যেতে পারে।
তোমরা কখন যাচ্ছ?
এখনও স্থির হয় নি। ইমাম যাওয়ার একটা ব্যবস্থা করবেন। আজই হয়তো ব্যাপারটা জানা যাবে। রেজা ভাই থিয়েটার রোডে গেছেন। যদি ইমাম লাঞ্চের জন্য বাসায় আসেন সব জানা যাবে।
আমি যদি যেতে চাই?
তোমাকে নিয়ে রওনা হওয়াটা ঠিক হবে না।
কেন?
বোঝো না, ঢাকা পর্যন্ত এসময় পৌঁছাটা আমাদের পক্ষেই কতটা বিপজ্জনক? কমরেড রেজাই সম্ভবত রাজি হবেন না। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধের প্রতিজ্ঞা যখন নিয়েছ তখন ট্রেনিং শেষ করা কর্তব্য। তোমার ক্যাম্প সম্বন্ধে যেসব অভিযোগ আছে তা ইমামকে জানাও। তিনি সম্ভবত তোমার নিরাপত্তার ব্যাপারে কিছু করতে পারবেন।
আমি ইমাম সাহেবকে কিছু বলব না। আর ঐ নরকেও ফিরে যাব না। যদি কিছু বলতে হয় তবে দেশের সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধা আলী রেজাকেই বলব। এখন চল নাসরিনকে দেখে আসি।
নন্দিনী চেয়ার ছেড়ে ওঠে দাঁড়ালে আমি বললাম, বস। নাসরিন ভালোই আছে। আমরা লাঞ্চের পর সকলেই ক্লিনিকে যাব।
নন্দিনী বলল।
এর মধ্যে একটা ট্রে হাতে করে নন্দিনীর জন্য কিছু খাবার ও দুকাপ চা নিয়ে পারুল এসে ঘরে ঢুকল।
আপনাদের দুকাপ চা দিতে এলাম। একটু আগে ইমাম আবার টেলিফোন করেছিল। সুখবর। কমরেড রেজার সাথে আমাদের সরকারের আলাপ হয়েছে। ইমাম একটা ফয়সালা করে দিয়েছেন। ইমাম বলল, রেজা সাহেব খুব খুশি। দুপুরে আমাদের সাথে খেতে আসছেন। যাই আমি গিয়ে রান্নাটা সেরে ফেলি।
পারুলও রেজার প্রতি তার গভীর সহানুভূতির ইঙ্গিত দিল এবং ট্রেটা নন্দিনীর দিকে এগিয়ে দিয়ে হাসল। নন্দিনী ট্রে বিছানার ওপর নামিয়ে রেখে চা ঢালতে ঢালতে বলল, তুমি যাও আমিও তোমাকে একটু সাহায্য করতে আসছি।
কোনো দরকার নেই দিদি। আমি একাই সব পারব। আপনারা বরং যুদ্ধের গল্প করুন। গতরাতে ইমাম বলেছে আমাদের ছেলেরা ঢাকায় নাকি খুব চোরা মার লাগাচ্ছে। একদম ভয় খেয়ে গেছে সবাই।
পারুলের মুখে বিজয়ের হাসি দেখে আমার খুব ভালো লাগল।
বেলা আড়াইটার দিকে রেজাভাইসহ ইমাম এসে বাসায় ঢুকেই বলল, তাড়াতাড়ি খানা লাগাও। খুব খিদে পেয়েছে।
আমরা সবাই এসে নিঃশব্দে খাওয়ার টেবিলে বসলাম। আমি মিতু ও নন্দিনী একদিকে। অন্যদিকে রেজাভাই ও ইমাম। পারুলের চেয়ারটা খালি রইল কারণ সে সবাইকে পরিবেশন করে তবে বসবে। খেতে বসেই রেজাভাই বললেন, কবি সাহেব আমাকে সাপোর্ট দিতে তাজউদ্দিন সাহেব রাজি হয়েছেন। আমরা ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হব।
আমি বুঝলাম খুব খুশির কথা রেজাভাই।
খুব বেশি খুশির কথা নয়। কারণ দেশের ভেতর এখন প্রতিরোধ যুদ্ধ মারাত্মকভাবে সাহস দেখাচ্ছে। গ্রামে গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের ঘাঁটি তৈরি হতে যাচ্ছে। এ অবস্থায় ভারতীয় বাহিনী স্বাধীনতা যুদ্ধজয়ের কৃতিত্বটা মুক্তিযোদ্ধাদের দেবে বলে মনে হয় না। আমার সন্দেহ ডিসেম্বরেই তারা হস্তক্ষেপ করবে।
আমরা কোনো জবাব দিলাম না। আমি ভেবেছিলাম ইমাম এর প্রতিবাদ করবে। কিন্তু সেও কোনো জবাব দিল না। শুধু নন্দিনী বলল, রেজাভাই আমি কী আপনাদের সাথে ঢাকা যেতে পারব?
আপনি যেতে চাইলে নিয়ে যাব। আমি ভেবেছিলাম নাসরিনের ভার আপনার হাতে দিয়ে আমরা নিশ্চিন্তে দেশের ভেতর ঢুকব। আপনি যে আর ট্রেনিং ক্যাম্পে ফিরবেন না তা আমি বাদুড়িয়ায় আপনার চেহারা দেখেই বুঝেছিলাম। এসব নিয়ে দুঃখ করে, নালিশ করে কোনো লাভ নেই বোন। এটা হল একটা আনঅর্গানাইজড ওয়ারফেয়ার। এ সুযোগে অনেক বাজে লোক এখানে ঢুকে পড়েছে। এদের উদ্দেশ্য স্বাধীনতা যুদ্ধ নয়। এদের আচরণে বিরক্ত হয়ে পুরো আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধটাকেই অর্থহীন ভাববেন না।