আমি অবাক হয়ে আলী রেজার মুখের দিকে তাকালাম।
তিনি হেসে আমার প্যাকেট থেকে আরও একটা সিগ্রেট তুলে নিয়ে তার মুখটা আমার কানের কাছে এগিয়ে এনে ফিসফিস করে বললেন, এমনকি এতক্ষণে সম্ভবত আপনার বোনজামাই মহোদয়ও জেনে গেছেন কুষ্টিয়ায় কমরেড রেজা এখন তার বাসায় বিশ্রাম নিচ্ছে। এখানকার ইন্টেলিজেন্স নেটওয়ার্ক খুব কড়া। তাছাড়া আমি বর্ডার ক্রশ করেই ভারতীয় কতৃপক্ষের কাছে আমার প্রেজেন্স রিপোর্ট করেছি। আপনি কবি মানুষ, দেশের ভেতরের এবং বাইরের রাজনৈতিক সংঘর্ষের খবর কিছুই জানেন না। আমি বাংলাদেশের ভেতর থেকে পাক বাহিনীর আক্রমণ অত্যাচারের মধ্যে যতটা নিরাপদ কলকাতায় ততটা নই কবি সাহেব।
আমি মুহূর্তের মধ্যে কমরেড রেজার রাজনৈতিক গুরুত্ব যেন উপলব্ধি করলাম।
আমি বললাম, রেজাভাই আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমোন। আমি ও আমার বোন ইমাম সাহেবকে আপনার সহযোগিতার প্রস্তাবে সম্মত করাব। অন্তত আপ্রাণ চেষ্টা করব।
রেজাভাই আমার কথার কোনো জবাব না দিয়ে চোখ মুদে সিগ্রেট টানতে লাগলেন। আমি কামরা থেকে বেরিয়ে এসে দুয়ারটা ভেজিয়ে দিলাম।
ঘন্টাখানেক পরে পারুল কিচেন থেকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে মিতুর ঘরে ঢুকল। আমি তখন ভাগ্নির সাথে তার স্কুল সম্বন্ধে এবং নতুন বান্ধবীদের সাথে মেলামেশার অভিজ্ঞতা নিয়ে আলাপ করছিলাম। পারুল বলল, আপনার অতিথি কমরেড রেজার সাথে ইমাম কথা বলতে চায়। অফিস থেকে টেলিফোন। ইমাম ধরে আছে।
আমি লাফ দিয়ে উঠলাম এবং রেজা ভাইয়ের তন্দ্রা ছুটিয়ে দিয়ে বললাম, আপনার টেলিফোন। ইমাম ধরে আছেন।
রেজাভাই হাসলেন, চলুন।
আমি তাকে পারুলদের বেডরুমে এনে টেবিলে রাখা রিসিভারটা দেখিয়ে দিলে তিনি রিসিভারে হাত রেখে বললেন, আপনি একটু বাইরে যান। আর দুয়ারটা ভেজিয়ে দিন।
আমি বাইরে এসে দুয়ার ভেজিয়ে দিলাম।
পনেরো মিনিট পর কমরেড রেজা হাসতে হাসতে বেরিয়ে এসে আমাকে ও পারুলকে অপেক্ষমান দেখে বললেন, আপনারা রান্নাটা বোধ আর খাওয়া হয়ে উঠল না। ইমাম সাহেব আট নম্বর থিয়েটার রোডে এক্ষুনি ডেকে পাঠিয়েছেন। তাজউদ্দিন সাহেব এই মুহূর্তে আমার সাথে কথা বলতে চাইছেন। আমি তাহলে আসি কবি সাহেব। আপনার বোনকে একটু অনুরোধ করছি নাসরিনের একটু খোঁজ খবর নিতে। আসি ধন্যবাদ।
আমি ও পারুল আমরা উভয়েই কমরেড রেজাকে অনুসরণ করে বাড়ির গেটে এসে দাঁড়ালাম। তিনি আমাদের দিকে একবারও ফিরে না তাকিয়ে একটা ট্যাক্সিতে গিয়ে উঠলেন।
আমরা হাত নেড়ে তাকে বিদায় জানালাম। তিনি মুখ ফিরিয়ে একটু হাসলেন মাত্র। গাড়িটা বেরিয়ে গেলে আমরা যখন ওপরে ওঠার সিঁড়িতে পা দিতে যাব তখন কে যেন পারুলের নাম ধরে পেছনের রাস্তা থেকে ডাকল। আমরা ফিরে দেখি খাকি প্যান্টশার্ট পরা নন্দিনী অন্য একটা ট্যাক্সি থেকে নামছে। প্রথম দৃষ্টিতে নন্দিনীকে চেনার কথা নয়। শাড়ির বদলে প্যান্টশার্ট শুধু নয়। নন্দিনী তার দীর্ঘ বেণীর বদলে চুল কেটে বব করে এসেছে। শুধু তার হাসিটাই অপরিবর্তিত। এগিয়ে এসে পারুলের হাত ধরে বলল, কেমন আছ পারুল, ইমাম সাহেব, মিতু এরা কেমন?
আমরা সবাই ভালো দিদি। বরং আপনার খবর বলুন, ট্রেনিং কেমন লাগছে?
খুব কষ্টকর। মানুষ সেখানে খুব নোংরা, লোভী। ম্লান মুখে জবাব দিল নন্দিনী।
আমি তার হাত আমার হাতে তুলে নিয়ে বললাম, আর কুশল জানার দরকার নেই, চলো ওপরে যাই।
নন্দিনী ওপরে এসেই পারুলকে বলল, তোমার একটা শাড়ি দাও তো পারুল। এই জবড়জং পোশাকগুলো খুলে একটু হালকা হই।
পারুল বলল, আসুন আমার কামরায়। শাড়ি ব্লাউজ দিচ্ছি। ইচ্ছে করলে গোসলও দিতে পারেন।
নন্দিনী খুশীতে লাফিয়ে উঠল, এ বাসায় বুঝি প্রচুর জল পাচ্ছ। দ্যাখো, যেখানে ছিলাম সেখানে লাইন বেঁধে জলের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে হত। আমি বরং আজ একটু প্রাণভরে গায়ে জল ঢেলেই আসি।
পারুল শাড়ি ব্লাউজ দেবার জন্য নন্দিনীকে তার কামরায় নিয়ে গেলে আমি এসে আমার বিছানায় বসলাম। আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না ইমাম কমরেড রেজাকে কী বিষয় আলোচনার জন্য ডেকে পাঠিয়েছে। তবে এটা বুঝলাম তাজউদ্দিনের সাথে আলাপের সুযোগ সৃষ্টি হওয়াতে রেজা ভাই খুশি মনেই বেরিয়ে গেছেন। ইমাম যদি দুপুরে খাওয়ার জন্যে বাসায় আসত তবে সবকিছুই জানা যেত। মনে হয় না ইমাম আজ লাঞ্চ খেতে বাসায় ফিরবে।
নন্দিনীর টয়লেট থেকে বেরুবার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে আমার চোখ দুটিতে তন্দ্রাভাব এসে যাওয়াতে আমি একটা বালিশ ঠেলে শুয়ে পড়লাম।
ঘুম ভাঙলে দেখি নন্দিনী আমার পাশে একটা চেয়ারে বসে আনন্দ বাজার পত্রিকা পড়ছে। সদ্য স্নান সেরে আসার পরিচ্ছন্নতা তার চোখেমুখে। সে পারুলের একটা লালপেড়ে গরদ ও লাল ব্লাউজ পরেছে। চমৎকার লাগছে নন্দিনীকে। তবে তার বিশাল বেণী না থাকায় বব করা চুল ফ্যানের বাতাসে মুখে এসে পড়ায় পোশাকের সাথে চেহারাকে খাপছাড়া লাগছে।
আমি বললাম, চুল কেটে ফেলাটা কী ট্রেনিংয়ের জন্য বাধ্যতামূলক?
না।
তবে এমন ন্যাড়া হওয়ার কী দরকার ছিল?
তখন যদি জানতাম আমার চুলগুলো তোমার চোখে খারাপ লাগত না তাহলে ন্যাড়া হতাম না।
কপালের ওপর থেকে একগুচ্ছ চুলকে আঙুল দিয়ে সরিয়ে জবাব দিল নন্দিনী।