হ্যাঁ হয়েছেই বলা যায়। তবে আমাদের ক্ষতিটা মারাত্মক। আমার ছজন সঙ্গীই মেশিনগানের গুলীতে শহীদ হয়েছে। কামানটার ব্যারেল ব্যাটারি সব লন্ডভন্ড। অস্ত্রের ক্ষতিটা আমি পুষিয়ে নিতে পারব। আপনাদের ফেরত দেয়া টাকায় অস্ত্র কেনা যাবে। কিন্তু যাদের আজ এই যুদ্ধে হারালাম তারা ছিল আমার আজীবনের আদর্শগত সাথী। উচ্চশিক্ষিত তাত্ত্বিক। বিপ্লবী ভ্রাতা। এদের ছাড়া আমাদের সমগ্র পার্টিটাই স্থবির হয়ে যাওয়ার আশংকা করছি। যাক আর দেরি করা উচিত হবে না। ঐ যে কমরেড মোজাফফরের লোকেরা স্ট্রেচার নিয়ে আসছে।
বললেন কমরেড আলী রেজা। গলা বিষাদে আক্রান্ত। দৃষ্টি উদাসীন। চারজন লোক একটা স্ট্রেচার এনে নাসরিনের পাশে রেখেই নাসরিনকে স্ট্রেচারে তুলে নিলো।
স্টেচারের মধ্যেই একটা সাদা চাদর ছিল। চাদরে তার দেহটা আবৃত করে দিলেন রেজা ভাই। নাসরিনের মুখ থেকে কোনো আহা উঁহু শব্দ নেই। ব্যথার কাতরানি নেই। সে সম্পূর্ণ অচৈতন্য।
আমি রেজা ভাইয়ের দিকে বিদায়ের জন্য মুখ তুললাম।
যান।
আমি উঠে দাঁড়িয়ে কিছু একটা বলতে গেলে রেজা বললেন, আমি বাদুড়িয়া ক্যাম্পে আপনার সঙ্গিনীকে ম্যাসেজ পাঠিয়ে দেব। তিনি কলকাতায় গিয়ে আপনার সাথে সাক্ষাৎ করবেন। সব ব্যবস্থা আমরা করব। আমরা কয়েকদিনের জন্য ইছামতীর ওপারে অবস্থান নেব।
১০. নাসরিনকে কলকাতার একটি ক্লিনিকে ভর্তি
নাসরিনকে কলকাতার একটি ক্লিনিকে ভর্তি করে দেয়া হল। বর্ডার ক্রশ করেই আমি ও মোজাফফর গ্রুপের লোকেরা আট নম্বর থিয়েটার রোডের অফিসে ইমামের সাথে যোগাযোগ করি। ভাগ্য ভালো যে তাকে সেখানেই পেয়ে যাই এবং হরিপুর চেক পোষ্টের কাছে একটি গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে আমাদের অবস্থানের কথা জানিয়ে দিই। তিনি সেদিন সন্ধ্যায় একজন ডাক্তার ও একজন নার্সসহ একটি এ্যাম্বুলেন্স মাইক্রোবাস পাঠিয়ে দিলে আমরা গভীর রাতে কলকাতায় পৌঁছি। ডাক্তার ও নার্সগণ মুহূর্তের মধ্যে নাসরিনকে ক্লিনিকের জরুরি বিভাগে তুলে নেয়। আমি বুঝলাম ইমাম সাহেব সব ব্যবস্থাই করে রেখেছেন। সম্ভবত এ ধরনের গুরুতর ঘটনা মোকাবেলা করতে করতে তিনি অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। আমি নাসরিনকে নিয়ে একাই এসেছি। মোজাফফর গ্রুপের লোকেরা নাসরিনকে এ্যাম্বুলেন্সে তুলে দিয়ে আমার কাছে বিদায় নিয়ে ফিরে যায়।
পার্ক স্ট্রীটের একটা দুতলা বাড়িতে ক্লিনিকটা। নাম রোজ ক্লিনিক। ক্লিনিকের লোজন নাসরিনের সাদা কাপড় ঢাকা দেহটাকে এ্যাম্বুলেন্সের ভেতরকার স্ট্রেচারসহ সরাসরি বয়ে এনে লিফটে ঢুকিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি সে মুহূর্তে রোগীর সাথে না গিয়ে একটা সিগ্রেট জ্বালিয়ে বারান্দায় পায়চারী করছিলাম। এ সময় একজন মহিলা ডাক্তার এসে আমাকে বলল, ওপরে চলুন। জয়বাংলা সরকারের একজন সেক্রেটারি আমাদের অফিস কামরায় আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।
আমি হাতের সিগ্রেটটা ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে বললাম, চলুন।
ওপরে এসে দেখি ক্লিনিকের ডাইরেক্টরের অফিস রুমে ইমাম ও পারুল আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। আমি ঢোকামাত্রই উভয়ে উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে সালাম জানাল। পারুল বলল, ভাই আপনি অক্ষত আছেন দেখে আল্লার শোকর আদায় করছি।
আমি হেসে একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললাম, দেহের বাইরেটা অক্ষত আছে বোন তবে ভেতরটা ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধটা কী এবং কোথায় চলছে আমি জানতে চেয়েছিলাম। এখন আমি তা জানি।
যুদ্ধটা আপনার কাজ নয় ভাই। লেখালেখিটাই আপনার কাজ। আশা করি আপনি এখন তা বুঝতে পারছেন। আমি দেশ থেকে আপনাকে স্বাধীনতা যুদ্ধের অভিজ্ঞতা নিয়ে কিছু লেখার জন্যই এনেছিলাম। কিন্তু আপনি ও নন্দিনী দিদি জিদ ধরে দেশের ভেতরে চলে গেলেন। এখন অন্তত আপনার যুদ্ধের সাধ মিটেছে।
বলল ইমাম।
আমি জবাব না দিয়ে চুপচাপ কতক্ষণ বসে থাকলাম। এরা আমার শুভার্থী এবং নিকট আত্মীয়। সরাসরি দেশের ভেতরে গিয়ে আমি বা আমার স্ত্রী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ি এটা এরা প্রথম থেকেই চায় নি। ইমামের ইচ্ছে ছিল আমি কলকাতায় থেকে মুক্তিযুদ্ধের ওপর কবিতা গল্প প্রবন্ধ লিখে মটিভেশনের কাজটা চালিয়ে যাই। এতে পূর্ব পরিচয়ের সূত্রে কলকাতার লেখকদের সাথে আমার বন্ধুত্ব ও বিনিময় বাড়বে। কিন্তু যুদ্ধের সময় পরিকল্পনা মোতাবেক কোনোকিছুই ঘটে না। কে জানতো আমার স্ত্রী তার ব্যক্তিগত শুভাশুতের চিন্তা না করে যুদ্ধের আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠবে। অথচ সে ইচ্ছে করলে নিরাপদে কলকাতায় বসে থেকে যুদ্ধের দিনগুলো কাটিয়ে দিতে পারত। আর নন্দিনী? দুর্ভাগ্যই কী নন্দিনীকে আমার কাছে এনে দিয়েছে না আমিই কর্তব্যবোধের চেয়েও অন্যবিধ কোনো মানবিক তাড়নায় নন্দিনীকে টেনে নিয়ে বেড়াচ্ছি। আমি পারুলের দিকে মুখ তুলে মিতুর কথা জিজ্ঞেস করলাম, তোরা মিতুকে আনিস নি কেন? মিতু কেমন?
মিতুকে এখানে একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছি। ভালোই। জবাব দিল পারুল।
ইমাম বলল, আপনি যে রোগিনীকে নিয়ে এসেছেন তাকে দেখতে গেছেন ডাঃ অজয় রায়। এই ক্লিনিকের পরিচালক। এক সময় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র ছিলেন। আমার সাথে আগে থেকেই পরিচয়। পরিচিত বলে এখানেই ব্যবস্থা করেছি।