আমাকে গুলী করে মেরে ফেলুন আমি আর সইতে পারছি না ওমা, মাগো।
নাসরিন আর কয়েক মিনিট, আমরা জিতে গেছি বোন। একটু পরেই তোমার চিকিৎসার ব্যবস্থা হবে।
আমি তাকে পিঠের ওপর হাত রেখে সান্ত্বনা দিতে লাগলাম। সে আবার একটা বাচ্চা মেয়ের মতো বিলাপ করতে লাগল। ব্যথা নিশ্চয়ই খুব তীব্র যা নাসরিনের বিকৃত ও ভেঙে যাওয়া কণ্ঠস্বর থেকে আমি খানিকটা আন্দাজ করতে পারছিলাম। আমার মুখ দিয়ে হঠাৎ বেরিয়ে গেল, নাসরিন আল্লার নাম বল। বল আল্লাহ আল্লাহ আমাকে পানাহ দাও।
আমার কথামতো নাসরিন ভাঙা বিকৃত গলায় আল্লাহ, আল্লাহ বলে কাঁদতে লাগল। আমি নাসরিনের মাথায় হাত রেখে স্কুলের জ্বলন্ত ভিটে বাড়ির ওপর নজর রাখলাম। ঠিক সেই মুহূর্তেই সবাইকে হতবাক করে দিয়ে মাঠের বাঁ পাশে দাঁড়ান একটা জিপের হেড লাইটের আলো জ্বলে উঠল। জিপটার স্টার্টের শব্দ শোনা যাচ্ছে। গাড়িটা তীব্র বেগে এগিয়ে এসেই বাঁক ঘুরে রাস্তায় নেমে গেল। এর আগেই আমাদের ছেলেরা জিপটার দিকে গুলীবর্ষণ করলেও জিপটা বেপরোয়া রাস্তায় নেমে পালিয়ে গেল। অন্য জিপটার দিকে কারা যেন হ্যান্ড গ্রেনেড ছুঁড়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। গ্রেনেড ফাটার বিকট শব্দ এলাকাটাকে কাঁপিয়ে দিলেও আমাদের বুঝতে বাকি রইল না দুশমনদের দুতিন জন আমাদের ফাঁকি দিয়ে চোখের সামনে পালিয়ে গেছে। গুলীর শব্দ থেমে গেলে আমি উঠে বসলাম। এক ধরনের হতাশা ও হতভম্বের মাঝে আমাদের বিজয় শেষ হল। একটু পরেই দূরের মসজিদ থেকে আজানের শব্দ ভেসে এল। মনে হল গত রাতের এই প্রচন্ড গুলীর শব্দ, কামান এবং লাইট মেশিন গানের শব্দের মধ্যেও যেন এলাকাবাসী নির্বিকার। প্রাত্যহিক নিয়মেই যেন মোয়াজ্জিন আজান হাঁকলেন। আমার কাছে ব্যাপারটা কেমন যেন একটু অস্বাভাবিক ঠেকল। এখান থেকে গ্রামগুলো খুব দূরে নয়, আশেপাশেই ছড়ান। রাতের এই প্রচন্ড যুদ্ধের ভয়াবহতা তারা না বুঝলেও নিশ্চয়ই গোলাগুলির শব্দে ঘুমোতে পারে নি। অথচ কেউ দল বেঁধে গ্রাম থেকে এদিকে এগোল না। জানতে চাইল না এখানটায় গতরাতে কী ঘটেছে? নাকি সব ভয়ে উদাসিনতার ভান করে দূরে সরে থাকতে চাইছে?
মাঠটার এদিক ওদিক থেকে নানা গ্রুপের মুক্তিরা টর্চের আলো ফেলে পরস্পরকে বিজয়সূচক অভিবাদন ও আনন্দ প্রকাশ করছে। এবার মাঠের মধ্যে সবাই উঠে দাঁড়িয়েছে। কেউ কেউ সিগ্রেট ধরাচ্ছে বুঝতে পেরে আমিও পকেট থেকে প্যাকেট খুলে একটা ধরালাম। এখন নাসরিনের কাতরানি একটু স্তিমিত হয়ে এসেছে। সম্ভবত নাসরিন আবার ঘুমিয়ে পড়েছে কিংবা অচৈতন্য হয়ে আছে। প্রতিহিংসামূলক ধর্ষণ যে কী ভয়াবহ ব্যাপার সে অভিজ্ঞতা তো আমার আগেই খানিকটা হয়েছে। নাসরিনের ব্যাপারটা একেবারেই আমার কাছে অসহনীয়। ঘৃণায় আমি আবার পাশে পড়ে থাকা নর পশুদের দিকে একবার দৃষ্টি ফেরালাম। নিষ্প্রাণভাবে কুঁকড়ে পড়ে আছে সব। হয়ত এদের নিজের দেশে এদের স্ত্রী পুত্র কন্যা আত্মীয়স্বজন প্রেম ভালবাসা সামাজিকতা সবই আছে। কিন্তু নিজের অজ্ঞাতেই পশুদের হুকুম তামিল করতে এসে নিজেরাই পশুর অধম আচরণ করে মানুষের ধর্ম ও মানবিক বিবেক পরিত্যাগ করে একদম পশু হয়ে গিয়ে প্রাণ হারাল।
আমার তন্ময়তার মধ্যে আলী রেজা এসে কখন যেন নাসরিনের পাশে বসলেন। হঠাৎ চমকে আমি মুখ তুলে তাকালাম। পূর্ব দিগন্ত তখন ফর্সা হয়ে গেছে। যদিও সূর্যের লাল আভা তখনও দেখা দেয় নি। আমি বললাম, রেজা ভাই?
আমাদের এখন আর কথা বলার সময় নেই কবি সাহেব। আমাদের এখনই স্থান ত্যাগ করতে হবে। শত্রুরা অচিরেই এখানে এসে পড়বে।
আমি বললাম, নাসরিনের অবস্থানে তো সুবিধের নয়। সে হেঁটে যেতে পারবে না। এতক্ষণ জ্ঞান ছিল। আমার সাথে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলেছে। সে আপনাদের কোনো গোপনীয়তাই শত্রুর কাছে ফাঁস করে নি। সে কারণেই বেশি জুলুম চলেছে তার ওপর। এখন মনে হয় ব্যথায় জ্ঞান হারিয়েছে।
নাসরিনকে আমি ট্রেনিং দিয়েছি কবি সাহেব, আমি জানি সে কিছু বলে নি। এখন তাকে এখান থেকে তুলে নিয়ে সীমান্ত পার হয়ে যেতে হবে। আমাদের লোক একজন বোকামি করে শত্রুদের ফেলে যাওয়া গাড়িটা জ্বালিয়ে দিয়েছে। তা না হলে এগাড়িতেই সীমান্ত পার হয়ে যাওয়া যেত।
এখন তাহলে কী ব্যবস্থা করবেন?
এ মেয়েটার জন্য আপনার সাহায্য দরকার। আপনার ভগ্নিপতি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের একজন হোমরাচোমরা। আপনি নাসরিনকে এক্ষুণি নিয়ে কলকাতায় রওনা হোন। সেখানে কোনো ক্লিনিকে রেখে তার চিকিৎসা করাতে হবে। খরচ আমরা দেব।
বললেন কমরেড আলী রেজা। তার গলায় পিতৃসুলভ মমতা ও আমার প্রতি গভীর বিশ্বাস ব্যক্ত হল। আমি বললাম, আমি তৈরি রেজা ভাই। আমি নাসরিনের জন্য সবকিছু করব। এখনি বলুন তাকে বহন করে নিয়ে যাওয়া যায় কী উপায়ে?
সে ব্যবস্থা হচ্ছে। মোজাফফর গ্রুপের লোকেরা একটা ইউনিটসহ স্ট্রেচারে রোগীকে নিয়ে আপনাদের সীমান্ত পার করে প্রাইভেট কারে তুলে দেবে। কথা হয়েছে। আমরা লতিফকে বাঁচিয়েছি। তারা এর প্রতিদান দিতে চায়। আমরাও এ সাহায্য নিতে বাধ্য। এমনিতে তাদের সাথে আমাদের আদর্শগত সংঘাত আছে। তবে এসময় সহযোগিতা।
কেমন যেন হতাশ গলায় আশার সংবাদ বললেন আলী রেজা। আমি বললাম, আপনার গলা কাঁপছে কেন রেজা ভাই? আপনার অপারেশন প্ল্যান কী সফল হয় নি?