আমি পানির খালি বোতল পাশে রেখে নাসরিনের মুখের কাছে মুখ নামিয়ে প্রশ্ন করলাম।
আমি এখন কোথায় হাদী ভাই?
স্কুলের মাঠে। আমাদের ছেলেরা স্কুলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। ভেতরে দুতিন জন এতক্ষণ প্রতিরোধ দিচ্ছিল। এবার বেরুবে কিংবা পুড়ে মরবে। দেখতে পাচ্ছ?
আমার কোমরটা নাড়াতে পারছি না। ওরা আমাকে কয়েকজন মিলে…
কথা বল না নাসরিন, আমি সব জানি। তুমি ওঠার চেষ্টা করো না। এটা রেজাভাইয়ের হুকুম। রেজাভাই অচেতন অবস্থায় তোমাকে এখানে দেখে গেছেন। আমাকে তোমার পাহারায় রেখে গেছেন। তোমার কোনো ভয় নেই।
আমাকে ওরা শেষ করে দিয়েছে হাদী ভাই। আমি উঠে দাঁড়াতে পারব না।
বলেই ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল নাসরিন।
আমি বললাম, সবই ঠিক হয়ে যাবে বোন। নিজেকে একটু শক্ত কর।
আমার কাছ থেকে এরা একটি কথাও বের করতে না পেরে দশ বারো জন মিলে…
আমি বললাম, আমরা সব জানি নাসরিন, একটু ধৈর্য ধর।
স্কুলে এনেই টেনে আমার কামিজ ছিঁড়ে, সেলোয়ার জোর করে খুলে নিয়ে…
একটু ধৈর্য, নাসরিন একটু অপেক্ষা। আমি তোমাকে ঢাকার ব্যবস্থা করছি।
আমি আমার শার্টটা দ্রুত হাতে খুলে নাসরিনের হাতে দেওয়া মাত্র সে তার নগ্নতা ঢাকার চেষ্টা করল। শার্টটায় তার উদোম নাভি ও নিম্নাংশ ঢাকা পড়ল বলে মনে হল। স্কুলের জ্বলন্ত অগ্নিশিখায় মাঠটা ফর্সা। আমি নাসরিনের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া মাত্রই মাঠটার চারদিক থেকে হই চই করে আমাদের সশস্ত্র গেরিলারা স্কুলের দিকে এ্যাডভান্স করতে লাগল। আর তক্ষুণি জ্বলন্ত স্কুলের জানালা থেকে তিনটি সশস্ত্র জোয়ান লাফিয়ে পড়ল স্কুলের বারান্দায়। সঙ্গে সঙ্গেই গুলীর ঝাঁক ছুটে গেল সেদিকে। আমিও আমার পিতল বারান্দার দিকে তাক করে দুহাতে বাগিয়ে ধরলাম। আমার হাত ও শরীর উত্তেজনায় থর থর করে কাঁপছে।
এক ঝলক গুলীর বাতাস কাটা শব্দ আমার ও নাসরিনের ওপর দিকে পার হয়ে গেল। নাসরিন আবার পাশ ফিরতে কাঁধ ও কোমর ফেরাবার চেষ্টা করছে। পারল না। ব্যথায় কঁকিয়ে কাঁদল, পারি না, হাদী ভাই। আমায় একটু ঘুরিয়ে দিন। আহ, ও মাগো।
আমি পিস্তল নামালাম।
পিঠে একটু ঠেলা দিন।
আমি পিস্তলটা রেখে নাসরিনের পিঠে আস্তে আস্তে ঠেলতে লাগলাম। এবার উপুড় হয়ে পড়ল সে। আমি বললাম, এই তো পেরেছ।
নাসরিনের পেছন দিকটা আবার উদোম হয়ে যাওয়াতে আমি শার্টটা টেনে ঢাকলাম। এখন শীতের প্রারম্ভকাল। বাতাসে একটু শীতের আমেজ পাওয়া যাচ্ছে। আমার গেঞ্জি পরা থাকলেও বেশ শীত লাগছে। কিন্তু নাসরিনের পিঠে ঠেলা দেবার সময় বুঝেছিলাম সে দর দর করে ঘামছে। আকাশে চাঁদের ফালিটা এখন দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠল। রাতের পাখিরা আগুনের শিখায় ও গুলীর শব্দের মধ্যেও কোথাও ডেকে চলেছে। খুব দূরের কোনো ঝোপঝাড় থেকে কোকিল ডেকে চলেছে। সম্ভবত রাতজাগা প্রাণিকুলদের মধ্যে চতুর্থ প্রহরের অতিক্রান্তি প্রাকৃতিক ইঙ্গিতের মতো ঘোষিত হল। বারুদের ঝঝে ভারী বাতাসেও জোনাকিরা জ্বলছে। ঝিঁঝির শব্দ উঠছে পেছনে ফেলে আসা নালাটার পাড় থেকে। এতক্ষণে সারা স্কুলটাই দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। অথচ অনতিদূরে মানুষের বসতিতে এর কোনো প্রতিক্রিয়া আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। গুলীর শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ বা কলরব এতক্ষণ শুনি নি। হানাদারদের জুলুম-অত্যাচারের ভয়ে সারা দেশের নিরুপায় সাধারণ মানুষ যেন বোবা হয়ে আছে। এর ওপর আছে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেয়ার অপবাদ ও নির্মম পীড়ণ। গাঁয়ের মেয়েদের ওপর হানাদাররা যে পৈশাচিক আচরণ ও ধর্ষণলীলা চালাচ্ছে তাতে নাৎসীরাও লজ্জা পেত। অথচ এরা নিজেদের মুসলমান বলে সারা দুনিয়ার কাছে প্রচার করে বেড়াচ্ছে। আজ হোক কিংবা কাল এরা পরাজিত হবেই। নীতিবোধহীন সেনাশক্তি আধুনিক মারণাত্রের জোরে ক্ষণকালের জন্য বিজয়ী হলেও পরাজয়ই এদের শেষ ভাগ্যলিপি। ইসলামের এমন অবমানকারীদের আল্লাহ নিশ্চয়ই শাস্তি দেবেন। অমর্যাদাই এদের ললাট লেখন। এইতো এরা এখন বাংলাদেশের সর্বত্র মুক্তিযোদ্ধাদের চোরগুপ্তা আক্রমণের মুখে দিশেহারা। এখানে আমাদের ষাট সত্তরজন আনাড়ি গেরিলার কাছে পরাজিত।
নাসরিন এতক্ষণ উপুড় হয়ে শোয়ার আরামটা পেয়ে চুপ করেছিল। এখন আবার গোঙানির শব্দ পাচ্ছি। আর ফুঁপিয়ে কান্না। আমি বললাম, খুব কষ্ট হচ্ছে?
কোমরের পেছনের হাড়ে খুব ব্যথা হচ্ছে। নাঈয়ের নিচেও হুল ফুটানোর ব্যথা। আহ।
ভালো লক্ষণ। এতক্ষণ তো তোমার সারা শরীরই অসাড় ছিল। ব্যথাবেদনা বোঝার বোধশক্তি ছিল না। এখন অন্তত ব্যথার অনুভূতিটা ফিরে আসছে। তুমি ভালো হয়ে যাবে নাসরিন।
ওরা আমাকে একদম শেষ করে দিয়েছে। আমি আর বোধহয় হাঁটাচলা করতে পারব না।
এবার বেশ জোরে বিলাপ করতে লাগল নাসরিন। আমি তাকে এখন সান্ত্বনা দেয়ার মতো কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছি না। শুধু আরও কিছুক্ষণ তাকে সহ্যের মধ্যে রাখতে পারলে হত। বললাম, আর সামান্য সময় মুখ বুজে পড়ে থাক বোন। তোমার সব ঠিক হয়ে যাবে। স্কুলের বারান্দায় এখনও দুতিন জন হানাদার পজিশন নিয়ে আছে। গুলী ছুঁড়ছে। এখানে মানুষের আওয়াজ পেলেই আমাদের নিশানা বানাবে। একটু চুপ করে থাক।
আমার কথায় নাসরিন ঘাসের ওপর ব্যথায় মুখ ঘসটাতে থাকল। এখন বিলাপ বন্ধ। মাঠের মাঝে যারা একটু আগে জয় বাংলা বলে হই চই তুলে অস্ত্র উঁচিয়ে স্কুলটা ঘিরে ফেলতে যাচ্ছিল তারা সবাই মাটিতে উপুড় হয়ে পড়েছে। বারান্দায় লাফিয়ে পড়া শত্রুদের এদের সবাই সম্ভবত দেখে সাবধান হয়েছে। কেউ হামাগুড়ি দিয়ে এগোচ্ছে বলেও মনে হল না। স্কুলের আগুনটা এতক্ষণে প্রায় মিইয়ে এসেছে। জ্বলন্ত চালা, কড়িকাঠ ইত্যাদি হঠাৎ কাঠামোসহ ভেঙে পড়ল মাটিতে। দৃশ্যটা দেখেই আমাদের পক্ষের গুলীর শব্দ বন্ধ হয়ে গেল। আগুনটা নিচে নেমে আসাতে মাঠের বুকে যে আবছা আলো ছিল তা এখন অন্ধকারে ডুবে গেল। বারান্দার দিকটাও নিস্তব্ধ। দুশমনরা আর জবাব দিচ্ছে না। এসময় হঠাৎ রেজাভাইয়ের গলা শুনতে পেলাম। তিনি স্কুলের মাত্র বিশ ত্রিশ গজ দূরে থেকে উর্দুতে শত্রুদের উদ্দেশ্যে কী যেন বললেন। আমি শুধু হাতিয়ার শব্দটাই বুঝতে পারলাম। পাকিস্তানীরা কোনো জবাব দিল না। তবে পাল্টা গুলীও না করাতে বোঝা গেল তারা সারেন্ডারের ব্যাপারে মনস্থির করতে পারছে না। এবার সারা মাঠ থেকেই আমাদের ছেলেরা সারেন্ডার সারেন্ডার বলে চীৎকার করে উঠল। তারপরই শুরু হল বেপরোয়া গুলীর ঝড়। অনেকক্ষণ পর্যন্ত একতরফাভাবে গুলীর তুফান বইতে লাগল। মনে হল সারেন্ডার করার জন্য বারান্দার নিচে আর কেউ বেঁচে নেই। পাল্টা একটাও গুলীর শব্দ না থাকাতে আলী রেজা মাঠের একদিক থেকে এ্যাডভান্স বলে কমান্ড দিলেন। গুলীর শব্দ জ্বলন্ত ভিটেটার দিকে এগোতে লাগল। আমি অবশ্যম্ভাবী পরিণামের জন্য উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। নাসরিন তার নাভির তীব্র ব্যথায় আমার একটা পা চেপে ধরেছে।