স্টার্ট।
আমরা আবার চলতে শুরু করলাম।
একটু এগিয়েই ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অনেকগুলো মৃতদেহের পাশে চলে এলাম। রেজা ভাই থামতে ইঙ্গিত করলে আমি থামলাম। আমার সামনেই ইউনিফর্ম পরিহিত একজন পাকিস্তানী জোয়ানের হাতের অস্ত্রটি ছিটকে গিয়ে পড়ে আছে কয়েক হাত দূরে। রেজা ভাই বললেন, দেখুন ত মড়াটার বেল্টে একটা রিভলবার আছে মনে হচ্ছে।
আমি দেখলাম আছে। বললাম, খুলে নেব?
আপনি আমার হাতের পিস্তলটা ধরুন।
রেজা আমাকে আমার পিস্তলটা ফিরিয়ে দিয়ে লাশের খাপ থেকে রিভলবার বের করে নিয়ে মুহূর্তের মধ্যে সেফটি পিন নামিয়ে বলে উঠলেন, খুব ভালো জিনিস। চাইনিজ মেড।
এসময় লাশগুলোর মাঝে একটা গোঙানি শুনতে পেয়ে আমরা উভয়েই হাতের অস্ত্র তাক করে অপেক্ষা করতে থাকলাম। রেজা ভাই বললেন, নাসরিন বেঁচে আছে। জ্ঞান ফিরে পাচ্ছে।
আমি তার কাছে এগিয়ে যাব?
লাশটির ওপর দিয়ে আস্তে পার হয়ে যান।
আমি মৃত জোয়ানের শরীরের ওপর নিজের বুকটা তুলে দিলাম। তারপর আস্তে করে গড়িয়ে নাসরিনের একটা হাত ধরে ফেললাম। এবার তার গোঙানি ও এলোমলো কথা কানে এল।
যতখুশি মারো আমি বলব না। মাগো।
আমি বললাম, নাসরিন। শুনতে পাচ্ছ? আমরা এসে গেছি। হানাদাররা খতম।
নাসরিনের হাতে আমি মৃদু ঝাঁকুনি দিলাম। কোনো সাড়াশব্দ নেই। সম্ভবত নাসরিন আবার চেতনা হারিয়েছে। এ সময় রেজা ভাই গুঁড়ি মেরে আমার পাশে চলে এলেন।
আবার অজ্ঞান হয়ে গেছে?
হ্যাঁ। এখন কী করব রেজাভাই?
আপনাকে এখানেই থাকতে হবে। যদি আবার জ্ঞান ফিরে ওকে উঠে বসতে দেবেন না। যে দুতিনজন এখনও স্কুলের ভেতর আছে এরা এখনই সারেন্ডার করতে বাধ্য হবে। মনে হয় রসদ ফুরিয়ে এসেছে। এখন আমাদের লোকেরা স্কুলল ঘরটায় আগুন লাগিয়ে দেবে। বাছাধনরা যদি জান বাঁচাবার জন্য মাঠে লাফিয়ে পড়ে কিংবা এদিকে এগিয়ে আসে তবে সোজাসুজি পিস্তল থেকে ফায়ার করবেন। দুহাতে পিস্তলের বাট ধরবেন, হাত কাঁপবে না। আমি অন্য পজিশনের দিকে যাচ্ছি। একটু পরেই সকালের আলো ফুটবে। এর আগেই আমাদের সব খতম করতে হবে।
রেজাভাই আমাকে ছেড়ে যাচ্ছেন শুনে আমি একটু ভয়ই পেলাম। বললাম, আপনারা এসময় এখানে থাকলেই ভালো হত। নাসরিন এখানে রয়েছে।
আমি না যাওয়া পর্যন্ত স্কুলঘরটায় এরা আগুন দেবে না। নাসরিনের জ্ঞান ফিরলে কী করতে হবে তা তো বলেছি। বুকে সাহস রাখুন। শেষ মুহূর্তে কোনো অঘটন যাতে না ঘটে সে দিকে সতর্ক থাকতে হবে। বুঝতে পারছেন না মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এটাই হল মুক্তিযোদ্ধাদের সবচেয়ে বড় সাফল্য। যদি ওদের রকেট লঞ্চারটা হাতাতে পারতাম তা হলে খুব ভালো হত। মনে হয় সে সুযোগ হবে না। সবকিছু আগুনে ছাই হয়ে যাবে। আর এ অপারেশনের পরই আমাদের সীমান্তের ওপারে পালাতে হবে। এরা এর মধ্যেই যশোর ক্যান্টনমেন্টে অয়্যারলেসে সম্ভবত বিপদের কথা জানিয়ে সংকেত পাঠিয়ে দিয়েছে। তবে ভোরের আগে সেখান থেকে সাহায্য এসে পৌঁছুতে পারবে না। এর আগেই সব খতম করে আমরা পালাব।
কথা শেষ করেই রেজাভাই ক্রল করতে শুরু করলেন। আবার প্রচন্ড গুলীর শব্দ মাঠটার চারদিক থেকে এসে স্কুল ঘরের একটি বিশেষ ক্লাসরুমে আঘাত হানতে লাগল। মনে হচ্ছে শত শত রাউন্ড গুলীর আঘাতে ঘরটার টিনের বেড়া, দরজা-জানালা ঝাঁঝরা হয়ে যাচ্ছে। এবার আমাদের পক্ষ থেকে গুলী বর্ষণের তোড় এমন বাড়ল যে, কুল থেকে মাঝে মধ্যে যে জবাব দেয়া হচ্ছিল তাও তলিয়ে গেল। আমি বুঝতে পারছিলাম না আমাদের পেছনের ব্যাটারি থেকে কোনো শব্দ পাচ্ছি না কেন? রকেটের বিস্ফোরণে এরা কী তবে শেষ হয়ে গেছে? নাকি আমাদের কামানটাই বিকল হয়েছে?
ভয় ও এসব এলোমেলো চিন্তাভাবনার মধ্যেই নাসরিন আবার কঁকিয়ে কেঁদে উঠল। তার একটা হাঁটু একটু উঁচু হয়েই পড়ে গেল। আমি তার হাতটা মুঠোর মধ্যে রেখে মৃদু ঝাঁকুনি দিলাম।
নাসরিন, আমি হাদী মীর।
বুঝতে পারলাম না নাসরিন আমার উপস্থিতি টের পেল কী না। তার নগ্নদেহটা একবার পাশ ফিরতে গিয়েও পারল না। আবার সে সটান হয়ে ফোঁপাতে শুরু করল। আমি আবার নাসরিনের হাত ধরে ঝাঁকুনি দিলাম।
নাসরিন, শুনতে পাচ্ছ?
পানি খাব। একটু পানি।
নাসরিন সম্বিৎ ফিরে পাচ্ছে। আমি তাড়াতাড়ি বললাম, নাসরিন, আমি হাদী ভাই। চিনতে পারছ?
পানি।
নাসরিন আবার অস্ফুট গোঙানিতে পানি চাইল। আমি পিস্তলটা কোমরে খুঁজে দিশেহারা হয়ে এদিক ওদিক দেখতে লাগলাম। হঠাৎ দেখি স্কুল ঘরটার চতুর্দিকে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। রেজা ভাই আগুন ধরিয়ে দেয়ার হুকুম ঠিকমতো দিতে পেরেছেন বুঝলাম। নাসরিন ক্রমাগত ভাঙা আওয়াজে তার তৃষ্ণা ব্যক্ত করতে লাগল, পা-নি।
আমি মুহূর্তমাত্র হতভম্ব অবস্থায় থেকে পাকিস্তানী জোয়ানদের লাশগুলোর দিকে দৃষ্টি ফেললাম। ভাবলাম যদি এদের বেল্টে কিংবা ইউনিফর্মের সাথে বাঁধা পানির বোতল থাকে? গুঁড়ি মেরে এগিয়ে গেলাম সামনের দেহটার কাছে। একটু হাতড়েই পেয়ে গেলাম পানির বোতল। অনায়াসেই তুলে নিয়ে ছুটে গেলাম নাসরিনের কাছে। কর্ক খুলে ঢেলে দিলাম মুখে। আমার হাত ঠক ঠক করে কাঁপছিল। পানি ছড়িয়ে গেল নাসরিনের চোখে মুখে গলায়। এবার মনে হল নাসরিন সম্পূর্ণ সম্বিৎ ফিরে পেয়েছে। আমি বললাম, নাসরিন আমি হাদী, হাদী মীর। তোমার কোনো ভয় নেই। হানাদাররা প্রায় সবই খতম। দ্যাখো রেজাভাই স্কুলটায় এ্যাটাক করেছে। এখন যুদ্ধ শেষ হবে। আমাদের জিত হচ্ছে। তুমি আমার কথা বুঝতে পারছ নাসরিন?