আমার পাশের কমরেড হঠাৎ তার সঙ্গীদের বলল, টার্গেট।
সাথে সাথেই ব্যারেলটা একটু সরে বারান্দার মধ্যমণি লোকটাকে তাক করল। ততক্ষণে নাসরিনের দেহটাকে মধ্য মাঠে টেনে এনে নর পশুরা যে দৃশ্যের অবতারণা করল তা না দেখার জন্য আমি আমার মাথা ঘাসের ভেতর নামিয়ে এনে ধরিত্রীর বুকে কপাল ঠেকিয়ে ফুঁপিয়ে উঠলাম।
আমার পিঠে কে যেন হাত রেখে মোলায়েম কণ্ঠে উচ্চারণ করল, আমরা সিগন্যাল পাচ্ছি। কানে আঙুল। ফায়ার।
প্রচন্ড শব্দে ব্যাটারী কার্যকর হয়ে উঠলে আমি আচমকা মাটি থেকে মাথা ওপরে তুললাম। কোথায় সে সার্চ লাইট আর কোথায় সেই স্কুল ঘর কিছুই বুঝতে পারছি না। শুধু মাঠটার চারদিক থেকে আচমকা শুরু হয়েছে ধারাবাহিক এল, এম, জির ফটাফট শব্দ। এর মধ্যে কামান একটু বিরাম দেওয়া মাত্রই শুনতে পেলাম স্থান বদলের ইঙ্গিত। দ্রুত হাতে কমরেডের কামানটাকে কয়েক ভাগে আলাদা করে ফেলে নালাটার, নিচে নেমে গেল। আমিও তাদের সাথে নামলাম। এর মধ্যে কে একজন ওপর থেকে হামাগুড়ি দিয়ে আমাদের ওপর এসে পড়েই হুকুম করলেন, তিরিশ গজ ডানে।
বুঝলাম রেজা ভাইয়ের গলা। আমরা দ্রুত তিরিশ গজ আন্দাজ ডানে ছুটে এসে মাথা মাটিতে লাগিয়ে শুয়ে পড়লাম। এবার মাঠের মধ্য থেকে এক ঝাঁক গুলী আমাদের দেহের ওপর দিকে শিস্ তুলে চলে গেল। আমার পাশে মাটিতে চিৎ হয়ে শোয়া অবস্থাতেই রেজা ভাই ও তার সঙ্গীরা ব্যারেলটা যুৎসই করে মাঠের দিকে তাক করল। কিন্তু এখন কারো উঠে বসার উপায় নেই কারণ মাঠের চারদিক থেকেই লাইট মেশিনগান ও চাইনিজ রাইফেলের গুলীর শব্দ উঠছে। এর মধ্যেই আলী রেজা আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, এনিমি প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। শুধু স্কুল ঘরটার ভেতর দুতিনজন পজিশন নিয়ে আছে। ভয়ে এলোপাথাড়ি গুলী চালিয়ে যাচ্ছে। একটু পরেই স্কুলটা আমাদের দখলে চলে আসবে।
আমি বললাম, নাসরিন?
মাঠের মধ্যে পড়ে আছে সম্ভবত এখনও বেঁচে আছে। তবে অজ্ঞান।
মাঠের মধ্যে অনেকগুলো হানাদার ছিল?
খতম। ঐ জিপগুলোর ভেতর আমাদের লোকেরা অন্ধকারে পজিশন নিয়ে ছিল। আমাদের গান থেকে প্রথম হিট করার সাথে সাথেই তারা মাঠে লাফিয়ে পড়ে সবাইকে খতম করে দিয়েছে। আমাদের এ্যাটাকে বারান্দার সেই গেঞ্জিপরা বদমাইশ মেজরটারও খুলি উড়ে গেছে।
আমাদের কারো কিছু হয় নি তো?
ছজন ডেড।
মাঠের অপারেশন নাসরিনের গায়ে গুলী লাগে নি তো?
আমার উৎকণ্ঠার কোনো জবাব না দিয়ে আলী রেজা হঠাৎ উঠে বসলেন। তার দেখাদেখি আমিও উঠে বসতে চেষ্টা করতে গেলে রেজাভাই আমার কাঁধে সজোরে চাপ দিয়ে মাটিতে শুইয়ে দিলেন।
মাথা তুলবেন না। স্কুলঘরের ভেতরে হারামজাদাদের হাতে একটা রকেট লঞ্চার আছে আমাদের ভারী অস্ত্রটা এরা খুঁজছে। একটু আভাস পেলেই কামান শুদ্ধ আমাদের উড়িয়ে দেবে।
আমি এবার অবস্থাটা ঠিকমতো আন্দাজ করতে পেরে মাটির ওপর কপাল রেখে আস্তে বললাম, আল্লাহ দয়া কর। আমাদের বিজয় দাও।
আলী রেজা কতক্ষণ স্থির হয়ে বসে থেকে মাঠের ওপর গাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলেন।
আমি বললাম, রেজাভাই আপনার গায়ে গুলী লাগতে পারে। আমার পাশে শুয়ে পড়ুন।
আমি এবার ক্রল করে নাসরিনের কাছে পৌঁছুতে পারি কিনা দেখি। আপনার পিস্তলটা কোথায়?
এইত আমার হাতেই আছে।
আমি আলী রেজার দিকে পিস্তলটা বাড়িয়ে দিলাম।
তিনি পিস্তলটা হাতে নিয়েই একজন সঙ্গীর দিকে নিচু হয়ে কী যেন বললেন। এই লোকটিই কামান থেকে প্রথম গোলা বর্ষণ করে স্কুলের বারান্দায় গেঞ্জিপরা মেজরটাকে খতম করেছিল। আলী রেজার ইঙ্গিতে সে কয়েক হাত গড়িয়ে গিয়ে ব্যারেলের পেছনে ব্যাটারির ওপর হাত রেখে পজিশন নিল। আলী রেজা এবার সরে এলেন আমার দিকে।
আমার পেছনে বুকে হেঁটে আসতে পারবেন?
আমি কোনো কিছু চিন্তা না করেই বললাম, পারব।
দ্যান ফলো মি।
আলী রেজা বুক ঘাসের ওপর হেঁচড়িয়ে কনুই দিয়ে চলতে শুরু করলেন। আমিও তাকে যথাযথ অনুসরণ করে চলতে লাগলাম। উত্তেজনায় আমি ঘাসের ওপর কনুই ছোঁয়াবার কষ্টটা টেরই পেলাম না। শুধু হাঁটুর দিকে প্যান্টের ভেতরে একটা ঘসটানির জ্বলুনি অনুভব করলেও বেপরোয়া রেজাভাইকে অনুসরণ করতে লাগলাম। আমরা পনেরো গজের মতো এগোতেই আমাদের পেছন থেকে বিপুল শব্দে গোলাবর্ষণ শুরু হল। রেজাভাই এগোনো বন্ধ করে ঘাসের ওপর মাথা রেখে স্তব্ধ হয়ে থাকলেন। আমিও তার মতোই ঘাসে মাথা রেখে কানে আঙুল দিলাম। ব্যারেল থেকে শেল ছিটকে বেরুবার আলোর ঝলক এসে পড়ছে আমাদের ওপর। গন্ধকের গন্ধের মতো এক ধরনের ঝাঁঝাল গন্ধ এসে লাগল নাকে। আবার মাঠটার চারদিক থেকে এবং স্কুল ঘরের একটা জানালা থেকে প্রবল শব্দে গুলী বিনিময় চলতে লাগল। আলী রেজা ঘাসের ওপর মুখ চেপে রেখেই আস্তে বললেন, নার্ভাস লাগছে?
মোটেই না।
তাহলে এগোন।
আমরা আবার কনুইয়ের ওপর ভর দিয়ে কয়েক গজ এগিয়েই থেমে পড়লাম। কারণ স্কুললটার ভেতর থেকে শিসের মতো এমন একটা শব্দ উঠেই আমাদের মাথার ওপর দিয়ে গিয়ে বিশ গজ পেছন তীব্র গর্জনে ফেটে পড়ল। মনে হল আমি বুঝি কালা হয়ে গেলাম। কিন্তু কিছু ভাববার আগেই আমাদের ব্যাটারী থেকে দুম দুম আওয়াজ তুলে আগুন ছিটকে যেতে লাগল। একটা ধোঁয়ার আস্তরণের ভেতর আমি ও রেজা ভাই তলিয়ে গেলাম। বিস্ফোরণের তীব্র গন্ধে চোখ জ্বলছে। এর মধ্যেই পিস্তলের বাট দিয়ে রেজা ভাই আমার পিঠে চাপ দিলেন।