গুলীর শব্দ হঠাৎ থেমে গেল।
০২. খানিক্ষণ একটা নিস্তব্ধতা
আমি বুঝতে পারছিলাম আমাদের চারদিকে দলের নারী-পুরুষ সবাই মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। আমার ভয় ছিল ছোটো বাচ্চাগুলোকে নিয়ে। কিন্তু তারাও আশ্চর্যজনক ভাবে নিশ্চুপ। কারো গলা দিয়ে কোনো কান্না, চীৎকার বা উশখুশের শব্দ শোনা গেল না। মৃত্যু বা বিপদের সম্মুখীন হলে মানুষ যে বয়েস নির্বিশেষে নির্বাক হয়ে যায় এ অভিজ্ঞতা আমার এমনভাবে আগে কখনো হয় নি। আমি সীমাকে বললাম, আরও কতক্ষণ এভাবেই থাকুন। দেখা যাক কপালে কী আছে। আমার মনে হয় যারা গুলী ছুঁড়েছে, তারা বুঝতে পেরেছে আমাদের হাতে কোনো অস্ত্র নেই। আনিসের দলও হতে পারে।
হায় ভগবান।
সীমা ফুঁপিয়ে উঠল।
আমার ওপাশ থেকে নন্দিনী আমার হাত চেপে ধরে আমাকে ইশারা করে বলল, কারা যেন আসছে।
আমি মাথা তুলে মাঠের অপর দিকে মাথা উঁচু করা মাত্রই দেখতে পেলাম কয়েকটা ছায়ামূর্তি মাঠের মাঝামাঝি এসে গেছে। খুব সতর্কতার সাথে তারা এগিয়ে আসছে। প্রত্যেকে সামনের দিকে ঝুঁকে কোনোকিছু খোঁজার ভঙ্গিতে এগোচ্ছে। সম্ভবত এদের প্রত্যেকের হাতেই রাইফেল বা স্টেনগান বাগানো আছে। মুহূর্ত মাত্র। লোকগুলো আমাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে বলে মনে হল। আমি বুকে ভরসা নিয়ে চীৎকার দিয়ে উঠলাম। আনিস আমরা, গুলী ছুঁড়ো না।
উঠে দাঁড়া হারামজাদা। তোর আনিসের মায়েরে..। সাবধান, দৌড় দেবার চেষ্টা করলে সবগুলোকে জানে মারব।
একটা বাজখাঁই গলায় আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম।
নন্দিনী ও সীমা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। আর্ত কান্না ছড়িয়ে পড়ল আমাদের দলের মধ্যে। এখন পূর্বদিক একটু ফর্সা হয়ে এসেছে। সামনের ঝোপঝাড় থেকে সুর করে অনেকগুলো কোকিল ডেকে উঠল। বাদুড়ের ঝাঁক উড়ে যাচ্ছে মাঠ পার হয়ে। মাঠের ওপাশ থেকে একটা কুকুরের ঘেউ ঘেউও শুনতে পেলাম। মনে হয় সামনের জমাটবাঁধা অন্ধকারের মতো জায়গাটা আসলে কোনো গ্রামই হবে। সম্ভবত সেখানকার লোকজনও গুলীর শব্দে এতক্ষণে জেগে গেছে। মনে মনে এখন আশা করছিলাম আশেপাশের গাঁয়ের মানুষ স্মাগলার কিংবা যত খারাপই হোক, এগিয়ে এসে আমাদের বাঁচাক। আমি বুঝতে পারছিলাম আমরা এখন প্রকৃত শত্রুদের হাতে পড়ে গেছি। এরা নিশ্চয়ই এই অঞ্চলের সবচেয়ে খারাপ গুণ্ডা বদমাইশের দল যারা পাক-হানাদার বাহিনীর প্ররোচনায় শান্তিবাহিনী বা রাজাকারদের খাতায় নাম লিখিয়েছে।
আমি আমার দুপাশে দুটি মহিলাকে নিয়ে কোনোমতে উঠে দাঁড়ালাম। আমাদের দাঁড়াবার আগেই দলের শিশু বৃদ্ধ সকলেই মাটি ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বিলাপ শুরু করেছে। বেশ কয়েকজন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা এর মধ্যেই এগিয়ে গিয়ে রাজাকারদের সর্দার লোকটার পা জড়িয়ে ধরতে গিয়ে লাথি খেয়ে ফিরে এল। লোকগুলো প্রথমেই আমাদের সকলের বোঁচকাবুচকি কেড়ে নিয়ে এসবের ভেতর টাকা-পয়সা গয়নাগাটি যা কিছু ছিল হাতিয়ে নিল। দলের কারোরই পরণে কোনো গয়নাপত্র ছিল না বলে এখন পর্যন্ত কারো গায়ে হাত দিতে হয় নি। দলে সীমা ও নন্দিনী ছাড়া আর যে কয়জন বয়সের দিক দিয়ে যুবতী বলে মনে হচ্ছিল, এদের প্রত্যেকের কোলে বা পাশে শিশু সন্তান থাকায় লোকগুলোর দৃষ্টি ছিল সীমা ও নন্দিনীর ওপর। তাছাড়া আমাদের দলের প্রায় সকলের পোশাক-আশাক ও ছবিসুরৎ দেখলে সহজেই বোঝা যায় এরা নিম্নশ্রেণীর হিন্দু। নমশূদ্র পরিবারের ভয়ার্ত নরনারী। কৃষক, জেলে, কামারকুমার যারা পাকিস্তানী আমলে বাস্তুভিটা, সামান্য চাষবাসের জমি ও জন্মগত পেশা পরিত্যাগ করে ভারতে চলে যেতে পারে নি এরাই এখন দলে দলে ভারতে প্রবেশের সুযোগ পেয়ে গ্রাম খালি করে হাজার হাজার বছরের প্রাচীন মাটি এবং মানচিত্র পরিত্যাগ করতে উদ্যত। সকলের চেহারার মধ্যেই এক অচেনা মৃত্যুর আতংক। এখন সকালের প্রথম আলো এসে পড়লো আমাদের ওপর। নন্দিনী ও সীমা যে নিম্নশ্রেণীর কোনো পেশাজীবী পরিবারের মেয়ে নয় তা এদের ফর্সা গাত্রবর্ণ, পোশাকের ঈষৎ আভিজাত্য ও চেহারা দেখলেই আঁচ করা যায়।
রাজাকারদের গ্রুপ লীডারটি এতক্ষণ দলের প্রত্যেকটি সদস্যকে তার রাইফেল উচিয়ে ঘুরে ফিরে পরখ করছিল। লোকটা বেশ লম্বা। একমাত্র তার পরণেই একটা নীল রংয়ের প্যান্ট ও গায়ে খাকি রংয়ের শার্ট। কোমরের বেল্টে একটা পিস্তলও ঝুলছে। অন্যেরা লুঙ্গি ও জামা পরা। কারো গায়ে শুধু গেঞ্জি। গ্রুপ লীডারটির গায়ের রং রোদে। পোড়া তামাটে। লম্বা নাকের নিচে মোটা একজোড়া গোঁফ। বয়স পঁয়ত্রিশের মতো হবে। অন্যেরা সকলেই অল্প বয়স্ক গাঁয়ের দীনমজুর শ্রেণীর কিশোর। গ্রুপ লীডারটা সীমা, নন্দিনী ও আমাকে বাদ দিয়ে দলের প্রায় সকলের সামনে গিয়েই এদের প্রত্যেককে পরখ করে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালো। রাইফেলটা কাঁধে ঝুলিয়ে পকেট থেকে একটা বগা সিগারেট বের করে আগুন ধরিয়ে কাঠিটা সীমার মুখের ওপর ছুঁড়ে দিল। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি চমকে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল।
এই মালাউনদের সর্দার কে, তুমি?
হ্যাঁ, আমার সাথেই এরা যাচ্ছে।
আমি যথাসম্ভব দৃঢ়তার সাথেই জবাব দিতে চেষ্টা করলাম। যদিও আমার হৃদপিণ্ডটা তখন আতংকে এমন তোলপাড় করে লাফাচ্ছিল যে এ অবস্থায় মানুষের গলা দিয়ে সাধারণত কথা সরে না।