আমি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে অস্ত্রটা কোমরে গুঁজে আলী রেজার পেছনে পেছনে এ পর্যন্ত এসেছি। রওনা হওয়ার সময়ই অপারেশনের প্ল্যানটা সবগুলো গ্রুপের কাছেই আলী রেজা ব্যাখ্যা করেছেন। সবাই একমত হয়ে বিভিন্ন পথ ধরে এখানে রওনা হয়ে এসেছে। অন্ধকারে কিছুই দেখা না গেলেও মাঠের ওপারে একটা লম্বা টিনের চাল আন্দাজ করা যায়। পশ্চিম দিকে একটা দেয়ালের পাশে দুটি ছাদঅলা মাঝারি সাইজের বড় সামরিক জিপ দাঁড়ানো। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হল হানাদারদের একটা পঁয়ত্রিশ জনের পুরো গ্রুপ এখানে থাকলেও স্কুলের বারান্দায় কোনো আলোর ব্যবস্থা রাখা হয় নি। বারান্দায়, মাঠ কিংবা জিপ দুটোর আশে পাশে কোনো সেন্ট্রির চলাফেরা দেখা যাচ্ছে না। মনে হয় সবাই স্কুল ঘরটার বিভিন্ন কামরায় ওঁৎ পেতে আছে। এদের সংখ্যাটা আলী রেজাই যোগাড় করেছেন।
নালাটার পাড় থেমেই আলী রেজা ও তার চার সঙ্গী প্রায় আড়াই হাত লম্বা ব্যারেলটা স্কুলের মাঠে রাখা গাড়ি দুটোর দিকে তাক করে ফিট করে ফেললেন। একটা ঝোলার ভেতর থেকে চকচকে ছোটো শেল বের করেই ব্যারেলের নিচের দিকে নিঃশব্দে বসিয়ে দিলেন। খুবই অনুচ্চ, প্রায় ফিসফিসানির মতো আনন্দ ধ্বনি বের হল সবার মুখ থেকেই। আমি বুঝলাম অন্ধকারে এই ক্ষুদ্র কামান বসানোর সাফল্যে এরা উল্লসিত। হঠাৎ রেজা আমার দিকে মুখ এগিয়ে এনে বললেন, আর দশ মিনিটের মধ্যে আমাদের কাজ শুরু হয়ে যাবে। আমাদের সহযোদ্ধারা আমার নির্দেশমত ঠিক ঠিক জায়গায় অবস্থান নিয়ে ফেলেছে। এখানে আমার এই চারজনের ইউনিটের সাথে আপনি চুপচাপ বসে থাকবেন। ফায়ারের সময় কানে আঙুল দিয়ে থাকবেন। ভয় পাবেন না।
আমি বললাম, আপনি?
আমি প্রত্যেকটা গ্রুপের পজিশন চেক করে সিগন্যাল দেব। কীভাবে দেব তা আপনি বুঝবেন না। যারা এ্যাকশন শুরু করবে তাদের বলা আছে তারা বুঝে যাবে। আমার এই গোলন্দাজ ইউনিট না নড়া পর্যন্ত আপনিও এখান থেকে নড়বেন না। মনে রাখবেন এটা হল অপারেশন কমান্ডারের হুকুম। একদম স্থির থাকবেন।
বলেই আলী রেজা কামানটার দুপাশে উবুড় হয়ে দুজন করে বসে থাকা সঙ্গীকে হাত দিয়ে একটা ইশারা করেই অন্ধকারে গুঁড়ি মেরে মিলিয়ে গেলেন।
আমি ও আমার সঙ্গীরা নিশ্বাস বন্ধ করে বসে থাকলাম। হঠাৎ কামানটার বাঁ পাশ থেকে একজন খুব নিচু স্বরে বলল, সিগন্যাল।
আমি কিছুই বুঝতে না পেরে অন্ধকার মাঠটার দিকে তাকলাম। না কোনো ইঙ্গিত বুঝতে পারছি না। শুধু ব্যারেলটা একটু উঁচু হয়ে উঠল বলে মনে হল। এদিকে আমার চারজন সঙ্গীর মধ্যে দুজন মাঠের দিকে মাথা একটু উঁচু রেখে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। কে একজন আমার কোমরের বেল্ট ধরে টান দিল, আমাদের মতো করে পজিশন নিন।
আমিও নিঃশব্দে কনুইয়ের ওপর ভার রেখে দুটি পা পেছন দিকে মেলে দিলাম। আমরা সকলেই নিষ্পলক তাকিয়ে আছি মাঠ আর ওপাশের ফুলটার দিকে। স্কুললটার ওপর পাতলা চাঁদ হঠাৎ মেঘের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে পড়ায় একটা হালকা আলো যেন অন্ধকারকে ঈষৎ ফিকে করে দিল। এখন গাড়ি দুটির অবস্থান অস্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। স্কুলের বারান্দাটাও অস্পষ্টভাবে নজরে আসছে। কিন্তু শত্রুদের কোনো চলাফেরা দেখছি না। আমি ফিসফিস করে আমার পাশে শুয়ে পড়া সঙ্গীকে বললাম, দুশমনদের কাউকে দেখা যাচ্ছে না কেন কিছু বুঝছি না।
তারা ঠিকমতোই পজিশন নিয়ে আছে। একটু পরেই বুঝতে পারবেন।
তার কথা শেষ হবার সাথে সাথেই নারী কণ্ঠের আর্ত চীৎকার শুনতে পেলাম। আর সাথে সাথেই স্কুলঘরের একটা দরজায় আলো জ্বলে উঠল। দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল পাঁচ ছজন শত্রু সেনা। এদের প্রত্যেকেই অস্ত্র উঁচিয়ে খোলা দরজার দুপাশে দাঁড়িয়ে গেলো। মুহূর্তমাত্র। এরপরই ক্লাস রুমের ভেতর থেকে সম্পূর্ণ উলঙ্গ একটি মেয়েকে চুলের মুঠি এবং দুদিকে হাতপা ধরে কয়েকজন হানাদার ঝুলন্ত অবস্থায় বের করে আনল। এদের পেছনে একজন সার্চ লাইট উঁচু করে ধরে আছে। দৃশ্যটা দেখামাত্রই আমি বুঝতে পারলাম নাসরিনের ওপর পাশবিক অত্যাচারের পর তার অচৈতন্য দেহটাকে পশুরা বাইরে নিয়ে এসেছে। রাগে, ঘৃণায় ও স্নায়বিক উত্তেজনায় আমি থর থর করে এমন। প্রবলভাবে কাঁপছিলাম যেন এই মুহূর্তে সারা দেহ কাঁপিয়ে আমাকে ম্যালেরিয়া আক্রমণ করেছে। সম্ভবত আমার সঙ্গীদের একজন কেউ অবস্থাটা বুঝতে পেরে আমার পিঠে হাত দিয়ে খুব শান্ত কণ্ঠে বলল, একটু ধৈর্য ধরুন। একটু পরেই আমাদের মেয়েটি রিলিজ হবে। প্লিজ কাঁপবেন না।
আমি একথায় গুঁড়ি মেরে লোকটার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম, কমরেড এ্যাকশন শুরু হচ্ছে না কেন? আপনারা কামান দাগছেন না কেন?
এ্যাকশনতো শুরু হয়ে গেছে। আমাদের লোকেরা এদের সব পজিশনে হুকুমের অপেক্ষায় ওৎ পেতে আছে। ঐযে গাড়ি দুটি দেখছেন এখন ও দুটোতে আমাদের ছেলেরা পজিশন নিয়ে রেখেছে। কামান দাগলে মেয়েটি মারা পড়বে। আমাদের কমান্ডারের ওপর ভরসা রাখুন। আর কথা বলবেন না। চুপ।
আমি চুপ করে এক দৃষ্টিতে স্কুলের বারান্দার দিকে তাকিয়ে রইলাম। নাসরিনকে এরা এখন বারান্দার ওপর ছুঁড়ে ফেলে তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। একজনকে মনে হল হাসতে হাসতে একটা সিগ্রেট ধরাল। কেউ আবার উবুড় হয়ে নাসরিনের নিরাবরণ অচৈতন্য শরীরের বিভিন্ন জায়গায় হাত দিয়ে পরখ করে সঙ্গীদের কী যেন বলছে। আর পেছন থেকে ক্লাসরুমের অন্ধকার গহ্বর থেকে একটা লোক প্যান্টের বোতাম বা চেইন টানতে টানতে বেরিয়ে এল। তার গায়ে গেঞ্জি। দূর থেকেও তার ফর্সা গায়ের রং বোঝা যায়। সম্ভবত এ লোকটাই এদের অধিনায়ক। সে বেরিয়ে এসেই কী যেন বলল। লোকগুলো আবার নাসরিনের নগ্ন দেহটাকে চ্যাঙদোলার মতো দুলিয়ে মাঠে নেমে পড়ল। যারা নাসরিনকে বহন করে মাঠে নামল তাদের পেছন পেছন বেশ কয়েকজন হানাদার লাইন বেঁধে মার্চ করে মাঠে নেমে পড়ল। গেঞ্জি পরা লোকটা এবং আরও কয়েকজন তখনও বারান্দায় দাঁড়িয়ে।