বলেই রেজা আমার দিকে ফিরলেন, আপনি আমার সাথে চলুন।
ততক্ষণে মরিয়ম ও আমীন দৌড়ে সামনের দিকে চলতে লাগল। রেজা আমার হাত ধরে টেনে উল্টো দিকে দৌড়ে চলতে ইঙ্গিত করায় আমি তার ছায়ার পেছনে দৌড়াতে লাগলাম।
ঘুটঘুটে অন্ধকারে পথ দেখতে পাচ্ছি না। তবুও আমি প্রাণপণ আলী রেজাকে অনুসরণ করে যাচ্ছি। দশ মিনিট চলার পরই হাঁপাতে লাগলাম। এর মধ্যে অন্ধকার পথে আন্দাজেই আলী রেজা পথ ছেড়ে মাঠের ভেতর নেমে পড়ল।
এখন একটু আস্তে চলতে পারেন। হেঁটে চলুন। আলী রেজাও দৌড় থামিয়ে হেঁটে চলেছেন। আমি এমনিতেই হাঁপিয়ে পড়েছিলাম। এখন আশ্বাস পেয়ে হাঁটতে লাগলাম। মনে হল হাঁটু সমান ধান ক্ষেতের ভেতর দিয়ে চলেছি। ঘাস আর কাদার গন্ধ। মাটি ভেজা বলে জুতো দেবে যাচ্ছে। অন্ধকারে উচ্চিংড়ে আর ফড়িংয়ের লাফালাফি চলছে। কোনো কোনোটা চোখেমুখে এসেও লাগছে। অন্ধকার এমন ভারি যে সামনে আলী রেজার ছায়ামূর্তিটা ছাড়া কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।
আপনি মোটামুটি সাহসী লোক কবি সাহেব। আমরা আপনাকে পরীক্ষার জন্য একটা কাজ দিয়ে চুয়াডাঙ্গা পাঠিয়েছিলাম। আপনি সফল হয়েছেন। আপনি এখন থেকে আমার সাথেই থাকবেন। তবে কমপক্ষে সাতদিনের একটা ট্রেনিং সেরে নিতে হবে।
আমার সামনে চলতে চলতে আলী রেজা হঠাৎ নম্র কণ্ঠে কথা বললেন।
আমি বললাম, রেজাভাই, আমি যুদ্ধ করতেই এসেছি। দীর্ঘদিন ট্রেনিং নিতে হলেও আমি তা নেব। আমার কোনো পলিটিক্যাল মোটিভেশন নেই কারণ অতীতে আমি কবিতা লেখা ছাড়া অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের সাথেই জড়িত ছিলাম না। আমার এখন একমাত্র ইচ্ছা দেশকে হানাদার মুক্ত করা।
আপনার এ সময়ও কবিতা লিখতে হবে কবি। আপনার কোনো পলিটিক্যাল মোটিভেশনেরও আমি দরকার দেখি না। যেটা দরকার সেটা হল সফিস্টিকেটেড ওয়েপন যা আমরা এই মুহূর্তে ব্যবহার করছি সেসব চালানোর জ্ঞান এবং হাতিয়ার হেফাজতের জরুরি শিক্ষা। এসব বিষয় আমিই আপনাকে শেখাতে পারব। এর জন্য কোনো ট্রেনিং ক্যাম্পে যাওয়ার দরকার নেই। আমি দেশের একজন প্রতিভাবান কবিকে এই যুদ্ধের অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ে সাহায্য করতে চাই। এর মধ্যে কোনো কবিতা হয়েছে?
এ পর্যন্ত কবিতা লেখার কোনো পরিবেশ বা অবসর জোটে নি।
আমার কথায় আলী রেজার চলন্ত ছায়াটা একটু দাঁড়াল। আমি তার পাশে যেতেই তিনি পিঠে হাত দিলেন।
এ পরিবেশেই আপনাকে লিখতে হবে। যুদ্ধ কাউকেই অবসর দেয় না কবি।
আমি বললাম, আপনার নির্দেশ আমি পালন করব কমরেড। তবে আজ রাতের অপারেশনে আমাকে আপনার পাশে থাকতে দিন।
এটা আমার পক্ষে খুব দায়িত্বজ্ঞানহীন ডিসিশন হবে।
আমি নাসরিনের এদের হাতে পড়াটা সহ্য করতে পারছি না। এরাতো পশুরও অধম?
নাসরিনের জন্য আমাদের পুরো গ্রুপটাই আজ প্রাণ বাজি রেখেছে। উদ্ধার করা যাবে কিনা জানি না। যদি এর মধ্যে মেয়েটাকে অত্যাচার করে মেরে না ফেলে তবে একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে। মেয়েটার বাপ মা বিশ্বাস করে আমার হাতে ওর দেখাশোনার ভার দিয়ে নিশ্চিন্ত আছে। আমার কথা এটুকুই, এরা নাসরিনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য স্কুলটায় আটকে রেখেছে। এখনও যশোর ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয় নি। সম্ভবত সকালে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার মতলব। আজ রাতেই আমরা নাসরিনকে উদ্ধার করব। জ্যান্ত কিংবা মৃত তা যে অবস্থাতেই হোক।
আমার হাত চেপে ধরে বললেন আলী রেজা।
আমি আবেগের সাথে বললাম, এ অপারেশনে আমি আপনার পাশে থেকে চাক্ষুস সবকিছু দেখতে চাই রেজা ভাই।
আলী রেজা কতক্ষণ নিশ্চুপ ভাবে আমার উষ্ণ, কম্পিত হাতখানি চেপে ধরে রেখে যেন আবেগের শিখায় তার নিজের সিদ্ধান্তকে উত্তপ্ত করে বললেন, আপনি থাকবেন। আমার পাশেই থাকবেন।
আমি খুশিতে চিৎকার করে উঠলাম, জয় বাংলা।
০৯. দর্শনা হল্ট প্রাথমিক বিদ্যালয়
রাত সাড়ে তিনটার দিকে আমরা দর্শনা হল্ট প্রাথমিক বিদ্যালয়টিকে তিন দিক থেকে ঘিরে ফেললাম। আমরা সর্বমোট একাত্তর জন মুক্তিযোদ্ধা। আমি ছাড়া সকলেই ট্রেনিং প্রাপ্ত। সকলের হাতেই আধুনিক অস্ত্র। মুজিববাদী গ্রুপের প্রায় সবার হাতেই স্টেনগান। দুএকটা এল, এম, জিও আছে। মোজাফফর গ্রুপও চাইনিজ রাইফেল, হ্যান্ড গ্রেনেড এবং একটা সাব মেশিনগান সঙ্গে করে এনেছে। কমরেড রেজার গ্রুপ অর্থাৎ আমাদের দলও সর্বাধুনিক চাইনিজ অস্ত্রে সজ্জিত। প্রত্যেকের বেল্টে বাঁধা গ্রেনেড। শুধু রেজা ভাই আরও চারজনের সাহায্যে একটা ভারী ব্যারেল এবং ব্যারেলের সাথে সংযুক্ত করার ব্যাটারী, স্ট্যান্ড, ইত্যাদি বহন করে এনে স্কুলের সামনের মাঠটার শেষপ্রান্তে একটা নালার উঁচু পাড়ে থামতে বললেন। আমাকেও একটা পিস্তল দেওয়া হয়েছে। যদিও আমি এ পর্যন্ত অস্ত্রটা চালাতে শিখি নি। তবুও দেওয়ার সময় আলী রেজা খুব তাড়াতাড়ির মধ্যে এর গুলীর পার্টসটা খুলে এবং লাগিয়ে আমাকে বিষয়টা মোটামুটি বুঝিয়ে দিয়েছেন এবং একবার মাত্র বুলেট খুলে অস্ত্রটার ট্রিগার টানার কায়দাটা দেখিয়ে দিয়ে বলেছেন, নিন এবার এই বুলেটের কেসটা চেম্বারে লাগান ত দেখি।
মনে হয় পারব।
বলেই আমি পিস্তলটার বাটের দিকে বুলেটের কেসটা ঠেলে ক্লিক শব্দে ঢুকিয়ে ফেললাম। আলী রেজা বললেন, সাবাস। যখন তাক করবেন তখন দুহাতে পেছন দিকটা শক্ত করে ধরে তাক করবেন। হঠাৎ এক হাতে ধরতে গেলে হাত কাঁপবে। তাছাড়া আপনার আঙুল ও কবজি খুব নরম। তাক ফসকে যাবে।