আমি ও মরিয়ম ফুটারে উঠে বসা মাত্র গাড়ি দ্রুতবেগে ছুটতে শুরু করল। স্কুটার আবাসিক এলাকা ছাড়িয়ে মাঠের পথ ধরে এগোতে লাগল। দুপাশে ধানের খেতের মাঝ দিয়ে খোয়া বিছানো এ্যাবড়ো থ্যাবড়ো রাস্তা। আমরা আসার সময় যে এপথে আসি নি তা বুঝতে পেরে আমি আমীনকে বললাম, আজ রাতটা অপেক্ষা করে রওনা হলে ভালো হত না?
না, তাহলে আমরা বিপদে পড়ে যেতাম। পাঞ্জাবিরা এখানে ব্যাপকভাবে তল্লাসি শুরু করেছে। এরা কী যেন একটা টের পেয়েছে। শুনলাম সিদ্ধিরগঞ্জের পাওয়ার স্টেশনের কাছে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের ফলে গত কালও ঢাকা শহর অন্ধকার ছিল। হানাদাররা ভয় পেয়ে এখানে যাকে সন্দেহ হচ্ছে তাকেই গুলী করছে। তাছাড়া আমার ওপর নির্দেশ আজই আপনাকে আর সিস্টারকে নিয়ে দর্শনায় ফিরে যাওয়ার।
স্কুটারের সামনে থেকে মুখ ঘুরিয়ে আমীন আমার দিকে তাকালে আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, যে পথে যাচ্ছি এতে বিপদ নেই তো?
এখন সব পথেই বিপদ আছে কমরেড। প্রাণ হাতে করেই এ পথে যাচ্ছি। তবে ভয় পাবেন না, আমি ও সিস্টার কেউই নিরস্ত্র নই। প্রাণ বাঁচাবার মতো হাতিয়ার আমাদের দুজনের কাছেই আছে। বিপদে পড়ে গেলে আপনি হতভম্ব হবেন না। আমাদের ডিরেকশনে চলবেন।
এবার মুখ না ঘুরিয়েই জবাব দিল আমীন।
আমি মরিয়মের দিকে তাকলে সে হেসে বোরখার নেকাবটা নামিয়ে দিল। এতক্ষণ তার মুখ খোলাই ছিল। আমি তাঁর আবৃত মুখখানা আর দেখতে না পেয়ে অন্যদিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে দেখি পশ্চিমদিকে সূর্য ডুবে যাওয়ার পরও আকাশের রক্তবর্ণ মিলিয়ে যায় নি। দুদিকে বিশাল সবুজ মাঠে আলো নিবে আসাতে সবুজের আস্তরণকে কেমন যেন একট কালচে দেখাচ্ছে। ধান ক্ষেতের ভেতর বা আশেপাশে কোনো কিষাণ বা মানুষজন চোখে পড়ছে না। এখানে পুরো অঞ্চলটাকেই আমার কেমন ভীতসন্ত্রস্ত বলে মনে হল। স্কুটারের শব্দে পথের ওপর থেকে একটা শেয়াল ধান ক্ষেতের আইল ধরে দৌড়ে পালিয়ে গেল। আমি বললাম, চলার সময় বামদিকে শেয়াল দেখলে কী হয়?
যাত্রা শুভ।
বলে মরিয়ম বোরখার ভেতরেই জোরে হেসে ফেলল। মরিয়মের হাসির শব্দে আমি আর আমীনও না হেসে পারলাম না। অনিশ্চিত আশংকার মধ্যে পথ চলতে গেলে মানুষের স্নায়ুর টানটান অবস্থা মানুষকে কতকটা বোকা ও প্রগলভ বানিয়ে ফেলে। আমি আর কথা না বলে চুপ করে সামনের দিকে তাকিয়ে রইলাম। স্কুটারের হেড লাইট এখনও জ্বালানো হয় নি। অস্পষ্ট আলোয়ই আমীন একমনে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আর খোয়া বিছানো অসমান পথে স্কুটার কেবল লাফিয়ে চলতে লাগল। নড়াচড়ায় গাড়ির ভেতরে আমি ও মরিয়ম অস্বস্তিবোধ করছিলাম। আমরা অনবরত পরস্পরের গায়ের ওপর পড়ে যাচ্ছিলাম।
.
রাত আটটার দিকে দর্শনা হল্ট স্টেশনের পেছনে এসে থামলে মরিয়ম বোরখা খুলে হাতের ওপর গুটিয়ে নিয়ে স্কুটার থেকে নামল। আমিও নেমে দাঁড়াতেই আমীন স্কুটারকে একটা গাছের নিচে দাঁড় করিয়ে ফিরে এসে বলল, আসুন আমার পেছনে।
আমরা তার পেছনে পেছনে চললাম। আমীন প্ল্যাটফর্মের দিকে না গিয়ে অন্য একটা ঘুরপথ দিয়ে আমাদের রেল লাইন পার করে একটা ছোটো কোয়ার্টারের সামনে নিয়ে এল। মনে হয় রেলের চতুর্থ শ্রেণীর কোনো কর্মচারীর আবাস। উঠোনে ঢুকে বাড়িতে কোনো লোকজনের সাড়াশব্দ পেলাম না। ঘরের ভেতর থেকে কোনো আলোর আভাসও দেখা যাচ্ছে না।
আমীন উঠোনে আমাদের নিয়ে কতক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে রইল। যেন তার বারান্দায় উঠতে দ্বিধা হচ্ছে। মরিয়ম বলল, আমার ব্যাগে টর্চ আছে, জ্বালব?
আমীন কিছু বলার আগেই মরিয়ম ব্যাগ থেকে টর্চ বের করে আলো ফেলল। ঘরের দরজায় বিশাল একটা তালা ঝুলছে। তালা দেখেই আমীন আতংকিত হয়ে বলল, নিশ্চয়ই কোনো বিপদ ঘটেছে। এখানে আর এক মুহূর্তও দাঁড়ানো ঠিক হবে না, চলুন।
আমরা উঠোন থেকে বেরুবার মুখেই হন্তদন্ত হয়ে একটি মানুষের ছায়া এসে আমীনের সামনে দাঁড়াল।
আমি রেজা, গুলী করো না।
আমীন ততক্ষণে তার পোশাকের গুপ্তস্থান থেকে পিস্তল বের করে ছায়ার দিকে নল উচিয়ে প্রস্তুত।
রেজা ভাই। কী ব্যাপার?
খুব বিপদ, লোকজন এ কোয়ার্টার থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। রোগী এখন আলিমপুরের আশরাফ হাজির বাড়িতে। লতিফের খিঁচুনি হচ্ছে তাড়াতাড়ি ডাক্তার দরকার। তোমাদের সাথে ডাক্তার কই?
ডাক্তার এখন চুয়াডাঙ্গায় নেই। আমি মরিয়ম রেজা ভাই। বুলেটটা বের করতে পারি কিনা একটু চেষ্টা করে দেখতে দিন।
বলল মরিয়ম।
বেশ, তুমি এক্ষুণি আমীনের সাথে আলিমপুর চলে যাও। সেখানে রোগীর অবস্থাও খুব খারাপ। আর এদিকে হানাদার বাহিনীর একটা গ্রুপ রাজাকারদের সহায়তায় ঘণ্টা খানেক আগে কাস্টম কলোনীতে হামলা চালিয়ে নাসরিনকে ধরে নিয়ে গেছে। পিস্তলটা পেয়েছে। এরা এখন একটা প্রাইমারি স্কুলে আস্তানা গেড়ে আছে। কলোনীতে গেট পাহাদারকে গুলী করে মেরেছে। এরা লতীফদের আক্রমণের প্রতিশোধ নিতে এসেছে। আমীন আর এক মুহূর্ত দেরি না করে তুমি হাজির বাড়িতে চলে যাও সেখানেই আজ রাতের প্ল্যানটা জানতে পারবে। আমরা রাতেই স্কুলে পাল্টা আক্রমণ করে। মোজাফফর গ্রুপকে খবর দেয়া হয়েছে তারাও এ অপারেশন আমাদের সাথে থাকছে। তাছাড়া ইছামতী পাড়ের বাদুড়িয়া ক্যাম্প থেকে সদ্য পাঠানো মুজিবাদীদের একটা গ্রুপ আমাদের শেল্টারে আছে তারাও আমাদের সাথে এই আক্রমণে রাজি। সব মিলে প্রায় পঞ্চাশ জন। তুমি মরিয়মকে পৌঁছে দিয়ে আমাদের ট্রেনিং ক্যাম্পে ফিরে এস।