আমি কিছু না বলে চুপ করে থাকলাম।
এবার আমি উঠি। সন্ধ্যায় নার্স মেয়েটি এসে আপনাকে যথাস্থানে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে উঠবে। আসি তাহলে।
মতিন সাহেব আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। আমি তার সাথে হাত মেলালে তিনি সকলকে সালাম দিয়ে বিদায় নিলেন। ঘরের বাইরে গিয়ে আবদুল্লাহর রিকশায় উঠলেন। আবদুল্লাহ রিকশার দিকে যেতে যেতে করিমনকে বলল, অতিথিকে চা টা দিও।
রিকশা বেল বাজিয়ে রাস্তায় গিয়ে উঠল। এবার করিমন আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন, এখনই কী চা দেব?
না একটু পরে দিলেও চলবে।
তাহলে আপনি বিশ্রাম নিন। আমি একটু বাসি বাসনপত্রগুলো ধুয়ে ফেলি।
আমি শুলেই ঘুমিয়ে পড়ব।
পড়ুন না। পাঞ্জাবিরা না এলে আমি আপনাকে জাগাব না। মনে রাখবেন এটা রাজাকার সর্দারের বাড়ি!
হাসল করিমন ওরফে সবিতা মজুমদার। বয়েস চল্লিশের কম হবে না। তবে দেহের অটুট গড়নে তাকে যুবতীই মনে হয়। তার হাসিটা বেশ অকপট এবং উদার বলেই মনে হল। এবার আমিও হাসলাম, তাহলে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ি, কী বলেন? আমি অবশ্যি আপনাদের অন্য পরিচয়ও জানি মিসেস মজুমদার।
এটা আমীনের ঠিক হয় নি।
আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন।
বিশ্বাস অবিশ্বাসের ব্যাপার নয় সতর্কতার ব্যাপার। যে কোনো মুহূর্তে আমি ও আমার সঙ্গী ধরা পড়ে যেতে পারি। ধরা পড়া মৃত্যু নয়, অসহ্য দৈহিক নির্যাতন। আপনি জানেন না ধরা পড়া মুক্তিযোদ্ধাদের কী পরিমাণ নির্যাতন করা হচ্ছে। শুনলে গা কাঁটা দিয়ে উঠবে। আচ্ছা এখন শুয়ে পড়ুন, আমি একটু ঘরকন্নার কাজ করি। আর ঘুমোতে না চাইলে অপেক্ষা করুন দশ মিনিট পরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে নিউজ বলবে। রেডিও ঐ বালিশটার নিচে তোষকের তলায় লুকানো আছে। আমি সেন্টার ঠিক করে রেখেছি। শুধু অন করে দিলেই চলবে।
করিমন বেরিয়ে গেলে আমি তোষকের তলা থেকে হালকা ট্রানজিষ্টারটা বের করে সামনে রাখলাম। দশ মিনিটকে মনে হল যেন দশ ঘন্টা পার হচ্ছে। কলকাতায় থাকতেও স্বাধীন বাংলা বেতার শোনার সুযোগ আমার বা নন্দিনীর তেমন হয় নি। যদিও ঐ বেতারের পরিচালক মন্ডলীর মধ্যে একজন ছিলেন আমারই ভগ্নিপতি। হঠাৎ পারুল আর মিতুর মুখ চকিতে মনের ভেতর ভেসে উঠল। মামা আপনাকে একটা সারপ্রাইজ দেব! এক্ষুণি ওপরে চলুন। হামিদার সাথে হোটেলের দেখা হওয়ার মুহূর্তটির কথা কেন জানি খুব মনে পড়ল। আমি রেডিওটা অন করে দিলাম।
অনেকক্ষণ পর্যন্ত একটানা একটা ঘরঘর শব্দের জন্য ঘোষকের গলা শুনতে পেলাম না। যখন শব্দটা স্পষ্ট হল শুনতে পেলাম, গতরাতে সিদ্ধিরগঞ্জ স্টেশনের কাছে এক আক্রমণে আমাদের বীর মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা ঢাকার সাথে বিদ্যুৎ সংযোগ ছিন্ন করে দিলে ঢাকা শহর অন্ধকারে ডুবে যায়। হানাদার বাহিনী এখন সর্বত্রই দিশেহারা। এখন পর্যন্ত ঢাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব হয় নি বলে জানা গেছে। এই আক্রমণে আমাদের একজন মুক্তিযোদ্ধা গুরুতরভাবে আহত হলেও অপারেশনের সময় সম্মুখ যুদ্ধে ৭ জন পাঞ্জাবি নিহত হয়। মুক্তিবাহিনীর ভয়ে নারায়ণগঞ্জের কলাবরেটররা শহরে আরও দৃঢ় পাহারা বসাবার জন্য জেনারেল নিয়াজীর কাছে দাবি জানিয়ে দেনদরবার করছে। ঢাকা থেকে খবর পাওয়া গেছে যে টাঙ্গাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ ও ভৈরবে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতার মুখে দিশেহারা ঘাতকবাহিনী গায়ের সাধারণ চাষী পরিবারগুলোর ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালাচ্ছে। যুবতী মেয়েদের ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং বাপ মায়ের চোখের সামনেই তাদের যুবক পুত্রদের গুলী করে মারা হচ্ছে।…
সংবাদ শেষ হলে রেডিওতে গান শুরু হল, একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি, আমরা।…
এসময় এককাপ চা নিয়ে করিমন ঘরে ঢুকল, নিন চা। ঢাকার খবর কি?
ভালো।
হেসে করিমন আমার পাশে এসে বসল। গানটা আরও একটু কমিয়ে দিলাম। এ সময় বাইরে রিকশার বেল বেজে ওঠায় করিমন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, সম্ভবত সিস্টার মরিয়ম এসেছে।
বোরখা পড়া একজন মেয়েকে নিয়ে আবদুল্লাহ ঘরে এসে ঢুকল।
আপনাকে এক্ষুণি একে নিয়ে রওয়ানা হতে হবে। সন্ধ্যার পর আপনাদের যাওয়ার রাস্তা নিরাপদ থাকবে না। উঠে পড়ুন।
আমি চায়ের কাপটা করিমনের হাতে দিয়ে নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ালাম। সিস্টার বোরখার নেকাব সরিয়ে মুখ বের করলে দেখলাম, শ্যামলা চেহারার এক যুবতী। হাতে ধাত্রী মেয়েদের মতো একটা ভারী ব্যাগ। বলল, আমি যাচ্ছি আপনার সাথে। আমার নাম মরিয়ম।
আমি হাত বাড়িয়ে মরিয়মের ব্যাগটা নিয়ে বললাম, চলুন।
আমি আর মরিয়ম পাশাপাশি রিকশায় বসলাম। আবদুল্লাহ রিকশা নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল।
.
আমরা সূর্যাস্তের আগেই চুয়াডাঙ্গা স্টেশন ক্রশ করে একটা মোটর পার্টসের দোকানের সামনে এসে নামলাম। মরিয়মই রিকশা থেকে নেমে আমাকে এখানে নামতে ইঙ্গিত করায় আমি নেমে গেলাম। আমাদের নামিয়ে দিয়েই আবদুল্লাহ রিকশা নিয়ে চলে গেল। আমরা দোকানটার বারান্দায় দাঁড়াবা মাত্রই হাওয়া থেকে যেন হু হু শব্দে স্কুটার নিয়ে আমীন হাজির হল।
তাড়াতাড়ি উঠে পড়ুন। মনে হয় এখানকার অবস্থা ভাল নয়। মুজিব বাহিনীর একটা গ্রুপ এখানকার একটা ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের বাড়ি আক্রমণ করে চেয়ারম্যানসহ কয়েকজনকে খতম করেছে। তার বাড়িতে শান্তিবাহিনীর বৈঠক হচ্ছিল।