আমি বললাম, আমারও হয়ে গেছে। আমিও হাতটা ধুয়েই আসি।
বেশ যান।
আমি পেছনের দরজা দিয়ে আমীনের পেছনে এসে দাঁড়ালাম।
আপনি যার নাম বলেছিলেন ইনিই সেই কমরেড?
হ্যাঁ।
আমীন হাসল।
আমি বললাম, আপনারা সব রহস্যময় মানুষ। মনে হচ্ছে আমি একটা বেশ বীরত্বপূর্ণ ঘটনার মধ্যে এসে পড়েছি।
আসলে তাই তবে ভয় পাবেন না, আমরাই জিতব।
বলে আমীন সোজা ঘরের ভেতর চলে যেতে উদ্যত হলে আমি বললাম, একটু দাঁড়ান। কমরেড আদিনাথকে তবে কোনো নামে ডাকব?
রিকশাওয়ালার নাম আবদুল্লা মিয়া। আপনি আবদুল্লা নামে ডাকবেন। তার স্ত্রী করিমন। মনে থাকবে?
প্রশ্ন করল আমীন। আমি বললাম, থাকবে বৈকি।
আমি আমীনের পেছনে ঘরের মধ্যে এলাম। আবদুল্লাহ চৌকির ওপর থেকে থালাবাটি মাটিতে নামিয়ে চাটাইয়ের ওপর চাদর বিছিয়ে দিয়েছে। ঘরে ঢুকেই আমীন বলল, আমি তাহলে চলি।
এসো উঠোনে দাঁড়িয়ে একটু কথা বলি।
একথা বলে আবদুল্লাহ আমীনকে নিয়ে ঘরের বাইরে স্কুটারের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। দশ মিনিট অনুচ্চস্বরে কথা বলার পর আমীন স্কুটারে স্টার্ট তুলে উঠোন থেকে নেমে গেলে আবদুল্লা ঘরে এসে আমাকে বললেন, আপনি এখন একটু বিশ্রাম করুন। এইমাত্র আপনার পরিচয় জানলাম। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের লেখকরাও অংশগ্রহণ করছে এটা আমাদের জন্য খুবই আনন্দের ব্যাপার। দেশের মানুষের সংগ্রামে যোগদান না করলে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা কোত্থেকে হবে। তবে কমরেড রেজার আপনাকে এখানে এই বিপজ্জনক মুহূর্তে পাঠানো সুবিবেচনার কাজ হয় নি। যে কোনো মুহূর্তে আমরা বিপদে পড়ে যেতে পারি। হানাদারদের ইনফর্মারদের ওপর খুবই চাপ আসছে আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টিটার সদস্যদের ধরিয়ে দেয়ার জন্য। খুব চাপ। অন্যদিকে ইন্দিরা গান্ধি চাইছেন না মুক্তিযুদ্ধটা আওয়ামী লীগের হাত ফসকে দেশের ভেতরকার মার্কসবাদী বিপ্লবী গ্রুপগুলোর হাতে চলে যাক। এ অবস্থায় আপনারা যারা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে এসে দাঁড়িয়েছেন তাদের কোনো রাজনৈতিক সচেতনতা কিংবা বিপ্লবী প্রস্তুতি নেই।
আমি বললাম, যুদ্ধটা কী দীর্ঘস্থায়ী হবে বলে আপনারা মনে করেন?
আমরা চাই এই লড়াই দীর্ঘস্থায়ী হোক। যুদ্ধ যতই বিলম্বিত হবে ততই আওয়ামী লীগের বুর্জোয়া অংশের সাথে তাদের তরুণ বিপ্লবী অংশের ভেতরকার দ্বন্দ্ব প্রকট হবে। ততদিনে দেশের সাধারণ মানুষের এই যুদ্ধে অংশ গ্রহণ ব্যাপকতর হবে এবং মুক্তিযুদ্ধে দিকনির্দেশনা দেওয়ার ক্ষমতা আওয়ামী লীগের সুবিধাবাদী গ্রুপ হারিয়ে ফেলবে।
আপনি কী মনে করেন ভারতীয় বাহিনী মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার নামে বাংলাদেশে প্রবেশ করবে?
আপনাদের নেতারা যারা এখন ভারত সরকারের অতিথি হয়ে কলকাতায় আরাম আর উদ্বেগের মধ্যে কাল কাটাচ্ছেন তারা চাইলেই প্রবেশ করবে। এমনকি না চাইলেও প্রবেশ করতে বাধা দিচ্ছে কে? কোটি কোটি শরণার্থীর অজুহাত তাছাড়া আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মস্কোর সমর্থন তো আছেই।
বললেন আবদুল্লাহ ওরফে কমরেড আদিনাথ।
আমি বললাম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তা কিছুতেই মানতে পারবেন না। সারাদেশ তার কথাতেই মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তিনি পাকিস্তানী শোষণের বদলে ভারতীয় শোষণ ডেকে আনতে পারেন না। আপনাদের তত্ত্বে নিশ্চয়ই কোথাও ভুল রয়ে গেছে। দেশবাসী শেখ সাহেবের নেতৃত্বে এখনও ঐক্যবদ্ধ। ভারত এই যুদ্ধে আমাদের সাহায্য, সহানুভূতি ও আশ্রয় দিচ্ছে। সহানুভূতিকে আধিপত্য বলে ধরে নিলে আপনাদের ভুল হবে কমরেড।
এ নিয়ে আমাদের আর তর্ক করে কী হবে। ভুল কার ভাঙবে তা বোঝা যাবে কয়েকমাস পরেই। এখন যুদ্ধটাই প্রধান। মতান্তর ভুলে এখন সেটাই চালিয়ে যেতে হবে। আপনি এবার একটু বিশ্রাম নিন।
বললেন আবদুল্লাহ।
আমি বললাম, এখন কী আর বিশ্রাম নেব। বরং আসুন একটা সিগ্রেট ধরাই। নিন।
ধন্যবাদ, আমি ধুমপান করি না।
এসময় করিমন এসে ঘরে ঢুকল। ঢোকা মাত্রই আবদুল্লাহ বললেন, কি ব্যাপার, প্রফেসর আসেন নি?
তিনি এখনই আসছেন।
করিমন আবদুল্লাহকে ইঙ্গিতে তার পিছনে যেতে বলে ঘরের পেছনে চলে গেলে আবদুল্লাহও তার পেছনে গেলেন। আমি একা সিগ্রেট টানতে টানতে একটু কাত হয়ে চৌকিতে শোয়া মাত্রই দুচোখে ঘুম নেমে এল। কিন্তু ঘুমিয়ে পড়ার আগেই তৃতীয় এক ব্যক্তি ঘরে এসে প্রবেশ করায় আমি চোখ মেলে তাকালাম। একজন বৃদ্ধ লোক। মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি। গায়ে শাদা পাঞ্জাবি। পরনে পায়জামা। চোখ দুটি খুব তীক্ষ্ণ সতর্ক এবং অনুসন্ধানী বলে মনে হল। আমাকে শুয়ে থাকতে দেখেই জিজ্ঞেস করলেন, আপনি দর্শনা থেকে এসেছেন?
আমি মুহূর্তের মধ্যে উঠে বসে জবাব দিলাম, হ্যাঁ।
আমার নাম মতিন।
আপনার একটা চিঠি আছে।
আমি চিঠিটা বের করে অধ্যাপক মতিনকে দিলাম।
তিনি চৌকিতে বসে চিঠিটা খুললেন। এর মধ্যে আবদুল্লাহ ও করিমন ঘরে ফিরে এল। মতিন চিঠি পড়ে কাগজটা ভাঁজ করে পকেটে রেখে বললেন, সার্জারীর যে ছেলের কথা চিঠিতে লেখা আছে সে জরুরি কাজে এখন ঢাকায়। আমরা একজন নার্সকে আপনার সঙ্গে দিচ্ছি। সার্জন না হলেও বহুদিন ঢাকায় সার্জিক্যাল অপারেশন কাটাছেঁড়ার কাজে সহকারী ছিল। বুলেটটা বের করে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে আসবে। বলবেন আহতকে রক্তদান ইত্যাদির প্রয়োজনে শেষপর্যন্ত কলকাতায় যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। বুলেটটা বের করার মতো অবস্থায় না থাকলে আমাদের নার্স সেটা করতে যাবে না। সেক্ষেত্রে সে ব্যথা ও অন্যান্য উপসর্গ ঠেকাবার জন্য ওষুধপত্র নিয়ে যাবে এবং রোগীর সাথে কলকাতার পর্যন্ত সঙ্গ দেবে। এর বেশি এখান থেকে আমরা কিছু করতে পারছি না।