বলেই ড্রাইভার গাড়ি স্লো করতে গিয়ে ব্রেক কষার শব্দ তুলল। আমি পকেট থেকে তাড়াতাড়ি প্যাকেট বের করে সিগ্রেট ধরালাম। ড্রাইভারকে একটা দেব কিনা ইতস্তত করার মধ্যে আমীন বলল, আমাকে এখন দেবেন না। এখান থেকে পথে আর কোনো কথা নয়।
আমি হাত গুটিয়ে আনলাম।
.
আমরা বেলা তিনটায় চুয়াডাঙ্গা স্টেশনকে বাঁয়ে রেখে একটা মাঠের মতো জায়গায় এসে পড়লাম। মাঠটার মাঝামাঝি একটা ডোবার পাড়ে কয়েকটি খড়ের চালাঘর। সম্ভবত খুবই হতদরিদ্র দুএকটি পরিবার এখানে বাস করে। ঘরবাড়ি শ্রীহীন। পাটকাঠির বেড়ার জন্য ভেতরের উঠোন বা অন্দর দেখা যাচ্ছে না। আমীন বাড়িটার কাছে এসেই স্কুটারের গতি কমিয়ে আনল এবং একবার মাঠের চারদিকটা মুহূর্তের মধ্যে দেখে নিয়ে বাড়িতে ঢোকার পথের ওপর গাড়ি তুলে এনে সোজা উঠোনে ঢুকে গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে দিল।
আমরা এখন এখানেই অপেক্ষা করব। আমার পেছনে আসুন।
আমি নেমে আমীনের পেছন পেছন একটা ঘরে এসে ঢুকলাম। ঘরের ভেতর একজন মধ্যবয়স্ক স্ত্রীলোক কুলোয় চাল বাছছিল। আমীনকে দেখেই বলল, খাওয়ার ব্যবস্থা করব?
হ্যাঁ আমরা খাব।
দুজনের মতো ভাত-তরকারি হবে মনে হয়।
স্ত্রীলোকটি কুলোর চাল কায়দা করে একপাশে সরিয়ে এনে উঠে দাঁড়াল। আমীন আমার দিকে ফিরে বলল, আসুন হাতমুখটা ধুয়ে বসে যাই। আপনারও খিদে পেয়েছে নিশ্চয়?
আমি বললাম, কোথায় যেতে হবে?
আমার পেছনে আসুন।
আমীন আমাকে নিয়ে ঘরটার পেছনে এসে দাঁড়াল। এখানে একটা নেবু ঝোপের পাশে মাটিতে মটকা বসানো। মটকার মুখে টিনের ঢাকনার ওপর পানি তোলার মগ রাখা আছে। আমিন ঢাকনা খুলে পানি তুলে হাত মুখে ঝাপটা দিল। আমার দিকে ফিরে বলল, আসুন।
আমি মগটা হাতে নিয়ে বললাম, চিঠিটা যার হাতে দেব সেই অধ্যাপক সাহেব কী এখানে আসবেন? না আমাদেরই অন্য কোথাও গিয়ে দিতে হবে?
আপনাকে এখন আর কিছুই করতে হবে না। খেয়ে চৌকির ওপর গড়াগড়ি যাবেন। আমি গিয়ে মতিন সাহেবকে খবর দেব। তিনি এলে আপনাকে যা করতে বলা হয়েছে তাই করবেন। আমি খেয়ে স্কুটার নিয়ে বেরিয়ে যাব। এখানে আর ফিরব না। যেখান থেকে ফের আপনি স্কুটারে উঠবেন সে জায়গাটা প্রফেসর সাহেব আপনাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন। কিংবা আপনাকে চিনিয়ে দিলে আপনি ডাক্তারকে সঙ্গে নিয়ে হেঁটেই চলে আসবেন। মনে রাখবেন এখন যে বেটি আমাদের খাওয়াবে সে এখানকার রাজাকার লীডারের স্ত্রী। আমাদের ফ্রেন্ড।
একটু হাসল আমীন।
আমি কথার কোনো জবাব না দিয়ে হাতমুখ ধুতে লাগলাম। স্ত্রীলোকটি ঘরের ভেতর থেকে একটা লাল গামছা নিয়ে বেরুল। আমীন গামছাটা নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, আসুন। আমরা খেতে বসলে করিমন প্রফেসরকে খবর দিতে যাবে। আমরা যে পাড়াটা পেছনে রেখে এসেছি মতিন সাহবেরে বাড়ি সেখানে। আমার বা আপনার সরাসরি সেখানে যাওয়া বিপদজ্জনক। আপনি এখানে থাকবেন। আমি অন্য জায়গায়। সব ব্যবস্থা ঠিকমতোই হয়ে যাবে। চিন্তা করবেন না।
আমীনের কথায় আমি নিশ্চিন্ত হলাম। বুঝলাম সব ব্যবস্থা শৃঙ্খলা মতোই এগোচ্ছে। আমার দুশ্চিন্তা বা উদ্বেগের মধ্যে থাকার কিছু নেই। হাতমুখ মুছে আমি চৌকিতে এসে বসলাম। সামনে ভাতের থালা। বাটিতে নলা মাছের শুকনো ভাজি, লালশাক আর ডাল। আমীন আমার পাতে মাছ ভাজা আর লাল শাক তুলে দিলে বলল, খান। করিমন ভালই রাঁধে। তাছাড়া খুব বুদ্ধিমতী মহিলা। এখনই আপনি যাকে চান তাকে খবর দিতে যাবে।
আমীনের কথায় করিমন একটু হেসে পেছনের দরজার দিয়ে ঘরের বাইরে চলে গেল। সত্যি খাওয়াটা অমৃতের মতোই লাগল। আমার প্রচন্ড খিদে থাকায় প্রচুর ভাত খেলাম। মনে হল আমার খাওয়া দেখে আমীনও পরিতৃপ্ত, করিমনের রান্নাটা দারুণ, না?
আমি বললাম, নিঃসন্দেহে দারুণ।
আমাদের সাথে কাজ করলে আরও বহুবার আপনাকে এখানে আসতে হবে।
তবে যে বললেন রাজাকারের বৌ?
রাজাকারের বৌ হলে আমাদের মিত্র হতে পারে না? আমীনের কথায় ঠাট্টার ইঙ্গিত স্পষ্ট। আমি কৌতূহলী দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালে তিনি হেসে ফেললেন।
আমাদের একজন নেতৃস্থানীয় কমরেড রাজাকারের স্ত্রী সেজে এক রিকশাওয়ালার সাথে ঘর করতে হচ্ছে। কিছু বুঝলেন?
না। রহস্য রেখে খুলে বলুন।
ইনি দিনাজপুরের কমরেড আদিনাথ মজুমদারের স্ত্রী সবিতা মজুমদার। হেঁয়ালি করছি না কবি সাহেব।
তার কথা শেষ হবার আগেই উঠোনে রিকশার বেল শুনে সেদিকে মুখ তুললাম। একজন শীর্ণকায় লোক ঘরে এসে আমাদের দিকে হাত তুলে সালাম দিল। পরণে চেক লুঙ্গি। শ্যামবর্ণ চেহারা। বয়েস পাশের মতো। গায়ে হাফহাতা ময়লা গেঞ্জি। বলল, পথে করিমনের সাথে এই মাত্র কথা হল। সে মতিনকে খবর দিতে গেছে। খাওয়া হয়ে গেলে তুমি আর দেরি করো না। চলে যাও।
আগন্তুক কাঁধের গামছাটা হাতে নিয়ে আমার দিকে তাকাল।
আমীন তাড়াতাড়ি বলল, একে রেজাভাই পাঠিয়েছেন। ইনি সঙ্গে ডাক্তারকে নিয়ে যাবেন। মতিন ভাইয়ের জন্য এর কাছে একটা চিঠি আছে।
ডাক্তার কেন?
একজনের গুলী লেগেছে।
আমাদের লোক?
না অন্য গ্রুপের।
বুকে?
ঊরুতে। খুব রক্ত গেছে। দুর্বল। আমাদের শেলটারে আছে।
থালা থেকে হাত তুলল আমীন, আমি হাত ধুয়ে আসছি।
আগন্তুক আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি আস্তে খান। আপনার তাড়াতাড়ি করতে হবে না।