আমি একটু হতবাক হয়ে গেলেও আলী রেজার কথায় সম্মতিসূচক মাথা নাড়লাম। তিনি আমাকে নিয়ে কোয়ার্টারের বাইরে এসে আগে থেকেই অপেক্ষমান স্থানীয় ভ্যান গাড়িতে চড়লেন। গাড়ি চলতে লাগল। যেতে যেতে তিনি বললেন, এই ভ্যানের চালক আমাদের লোক। এ আপনাকে আমাদের একটা প্রাইভেট স্কুটারে তুলে দেবে। মনে রাখবেন স্কুটার ড্রাইভারও আমাদের লোক। মুক্তিযোদ্ধা। সে আপনাকে চুয়াডাঙ্গা যে বাড়িতে নিয়ে যাবে সেখানে গিয়ে প্রফেসর আবদুল মতিনকে আপনি আমার এই চিঠিটা দেবেন। তিনি সব ব্যবস্থা করে সন্ধ্যায় সার্জারীর ছাত্রটি সহ স্কুটারে তুলে দিলে আপনি রেল কোয়ার্টারে এসে রিপোর্ট করবেন। নিন এই চিঠি আর খামটার মধ্যে এক হাজার টাকা আছে।
আলী রেজা আমাকে পকেট থেকে চিঠি ও টাকার খামটা দিলেন। আমি হাত পেতে নিয়ে চিঠি ও টাকার খাম সাবধানে পকেটে রাখলাম।
.
ভ্যান গাড়িটা একটু এগিয়ে গিয়ে স্টেশনের বাঁ দিকের পথ ধরল। এতক্ষণে আমি একটু ধাতস্থ হয়েছি। আলী রেজার হঠাৎ সিদ্ধান্তে নন্দিনী ও আমার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়াটা আমাকে একটু হতবাকই করে ফেলেছিল। এখন আমি একটু উপলব্ধি করছিলাম নিজের ইচ্ছাতেই আমি ও নন্দিনী জীবনের মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছি। মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত রাজনীতি সম্বন্ধে আমার ও নন্দিনীর ধারণাই ছিল অস্পষ্ট। কিন্তু যুদ্ধটা ছিল প্রত্যক্ষ। আমরা আগরতলার যাত্রাপথে বামুটিয়া বাজারের কাছে কেবল মারণাস্ত্রের শব্দই শুনি নি। যুদ্ধের প্রকৃত হিংস্রতা এবং প্রিয়জনের মৃত্যুর দৃশ্যের সাথে নিজের পক্ষের লোকদের অমানুষিক আচরণও প্রত্যক্ষ করেছি। যুদ্ধ যে মানবিক ব্যাপার নয় বরং মানুষের সভ্য স্বভাবের অধঃপতন এটা আমার চেয়ে বেশি বুঝেছিল নন্দিনী। তবুও যুদ্ধ সুবিচার ও স্বাধীনতার জন্য আমাদের উভয়ের কাছেই ছিল একান্ত জরুরি। আর হামিদা তো লড়াইয়ের মধ্যেই তার বেঁচে থাকার সার্থকতা খুঁজতে স্বামীকেও, যে কিনা একজন কবি, ছেড়ে যেতে দ্বিধা করে নি। যুদ্ধ যত নির্মমই হোক এখন আমি সম্ভবত এর সামনাসামনি এসে পড়েছি। এ অবস্থায় আমার পক্ষে মৃত্যুবরণ যতটা কাম্য, ধরা পড়াটা কিছুতেই নয়।
গাড়ীটা এতক্ষণে একটা গাঁয়ে এসে পড়েছে। আলী রেজা এবার আমার সাথে কথা বলার জন্য মুখ ফেরালেন। তার মুখে একটা উদার হাসি খেলে যাচ্ছে।
এবার একটি সিগ্রেট চলতে পারে।
আমি পকেট থেকে সিগ্রেট ও দেশলাই বের করে তাকে দিলাম।
এবারও আমি কোনো জবাব দিলাম না। তার হাত থেকে প্যাকেটটা নিয়ে নিজে একটা ধরালাম।
এ সময় জরুরি কাজে চলাফেলার কেউ কাউকে সতর্ক করা মানে অযথা ভয় পাইয়ে দেয়া। তবুও নতুন মানুষ ও অচেনা জায়গা বলে আপনাকে কতগুলো নির্দেশনা দিতে চাই। ভ্যানগাড়ি আর একটু এগিয়ে আপনাকে স্কুটারে তুলে দেবে। সে গাড়ির চালক সশস্ত্র। যদি পথে কেউ গাড়ি থামাতে চায় গাড়ি থামবে না। আপনি কোনো অবস্থাতেই ড্রাইভারকে থামতে বলবেন না। আপনি গাড়িতে স্থির হয়ে বসে থাকবেন। তবে ড্রাইভার যদি কোথাও গাড়ি ছেড়ে পালাতে থাকে আপনি বিনা বাক্য ব্যয়ে তাকে ফলো করবেন। সে যদি বাধ্য হয়ে কাউকে চার্জ করে তবে ভাববেন সে সঠিক কাজই করেছে। তার ইঙ্গিতের দিকে লক্ষ্য রাখবেন। সে কোথাও কোনো দোকানে চা খেতে নামলে আপনিও নামবেন। কোনো প্রশ্ন করবেন না। আপনি নিজে থেকে কারও কোনো জিজ্ঞাসার জবাব দেবেন না। ড্রাইভার আমীনই কথা বলবে। আর মনে রাখবেন ধরা পড়ার চেয়ে মুত্যুই শ্রেয়।
আলী রেজার কথা শেষ হওয়ার আগেই ভ্যান গাড়িটা মোড় ঘুরল। সামনেই পিচঢালা বড় রাস্তা। আলী রেজা ভ্যান থেকে নেমে পড়ল।
আসুন, জয় বাংলা।
জয় বাংলা।
আমিও আলী রেজার প্রতিধ্বনি করলাম।
সে হেসে বাঁক ঘুরে গাছপালা ঘেরা একটা বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। ভ্যানগাড়ি ততক্ষণে বড় রাস্তায় এসে উঠেছে। আর আমরা রাস্তায় ওঠা মাত্রই কোত্থেকে যেন একটা স্কুটার মৃদু শব্দ তুলে ভ্যানগাড়ির একরকম পথ আটকে দাঁড়াল।
ভ্যানগাড়ির চালক যার মুখটা এতক্ষণ আমি ঠিকমত নজর করতে পারি নি, কারণ আমি ও আলী রেজার কথাবার্তার মধ্যে সে একবারও আমাদের দিকে ফিরে তাকায় নি। এবার তার মুখখানা দেখলাম। একজন পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের যুবক। পরনে ময়লা সবুজ লুঙ্গি ও ঘেঁড়া গেঞ্জি। পায়ে রবারের স্যান্ডেল। মুখভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি। গায়ের রং ফর্সা। গলায় রুপোর তাবিজ। আমার দিকে ফিরে বলল, স্কুটারে উঠে পড়ুন। জলদি।
আমি নিঃশব্দে স্কুটারে উঠে বসলাম। স্টার্ট চালু ছিল। গাড়ি চলাতে লাগল বাতাসের বেগে।
আমার নাম আমীন।
আমি হাদী মীর।
আপনার পরিচয় আমার জানা।
ড্রাইভার মুহূর্তের জন্য এক পলক আমার দিকে ঘাড় ফেরাল। হাসি মুখ। চমৎকার স্মার্ট চেহারা। স্বাস্থ্যবান বলিষ্ঠ বাহু। সজোরে হ্যান্ডেল ধরে আছে। কালো রংয়ের হাফহাতা বুশ শার্ট ও জিনসের প্যান্ট পরনে। কানের ওপর ডান দিকে একটা সরু ক্ষতচিহ্নের দাগ। দাগটা কোঁকড়ানো ঘন চুলের ওপরও জ্বলজ্বল করছে। মোটা বলিষ্ঠ ঘাড় দেখলে বডি বিল্ডারের মতো মনে হয়।
আমি বললাম, গাড়িতে বসে সিগ্রেট-টিগ্রেট খেতে কোনো মানা নাইতো কমরেড?
আরে না, আরামসে খান।