নিজের বৌকে অমন অবাক হয়ে দেখতে হয় নাকি?
হাসির খিল খিল শব্দ তুলে চায়ের কাপ হাতে নাসরিন।
আমি তাড়াতাড়ি মশারি সরিয়ে বাইরে আসতে আসতে বললাম, দুঃখ কষ্টে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছুটে বেরিয়েই তো দিন কেটে যাচ্ছে। নিজের আপনজনকে চোখ ভরে তেমন করে আর দেখতে পেলাম কই?
বেশ তো দেখুন না। নিন চায়ের কাপটা ধরুন। চা খেতে খেতে নয়ন ভরে দেখুন। আমি মশারিটা তুলে দিচ্ছি। নাসরিন আমার হাতে চায়ের কাপটা ধরিয়ে দিয়ে মশারি তুলতে গেলে নন্দিনীর ঘুম ভেঙে গেল। সে ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসল, কি ব্যাপার আমাকে জাগাও নি কেন?
জাগাব কি, আপনার সাহেব তো ঘুমের মধ্যে আপনার রূপ দেখেই কূল পাচ্ছে না।
মুখের ওপর হাত রেখে হাসি লুকোতে চেষ্টা করল নাসরিন।
নন্দিনী তার আগোছালো চুল টেনে এনে খোঁপা বাঁধল। বিছানা থেকে নেমে শাড়ি ঠিক করতে করতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এর মধ্যে চাও পেয়ে গেলে? নাসরিন তো খুব ভাল মেয়ে দেখতে পাচ্ছি। আমি ট্রেনিংয়ে চলে গেলে তোমার খুব অসুবিধে হবে না।
নাসরিন ঠোঁটে আঙুল রেখে আমাদের সতর্ক করে বলল, একটু আস্তে কথা বলুন। কলোনীর মানুষজন জাগছে। নাস্তার পরই আপনাদের পাশের একটা বাড়িতে যেতে হবে। সেখান থেকে দুজনকে দুদিক চালান করে দেয়া হবে। আমি রুটি বেলে আনছি। শুধু রুটি আর চা। আর কিছু নেই ঘরে। এ খেয়েই সকালটা কাটাতে হবে।
আমি হাত নেড়ে আমাদের সন্তুষ্টি ব্যক্ত করলাম। নাসরিন নাস্তার যোগাড়ে অন্য ঘরে চলে গেলে আমি মৃদুস্বরে বললাম, মনে হয় চমৎকার ঘুম হয়েছে নন্দিনী।
কী করে বুঝলে?
আমি জেগে থেকে তোমার সুখনিদ্রা উপভোগ করার দৃশ্যটা প্রাণভরে দেখে নিয়েছি।
তুমি ঘুমাও নি?
ঘুম পাচ্ছিল না।
ঘুমের ওষুধ তো আমি বাৎলেছিলাম। তুমিই নিলে না। এখন আমার ঘুমন্ত দেহের বা রূপের প্রশংসা করে ভুলিও না তো।
আজ ছাড়াছাড়ির দিনটায় ঝগড়া করে তিক্ত করে যেও না নন্দিনী। আমি তোমাকে ভালবাসি বলেই সম্মান করি। লঙ্ঘন করতে সাহস হচ্ছে না বলে আমাকে কাপুরুষ ভেবো না। এটুকু অতৃপ্তি না নিয়ে গেলে আমরা পরিস্থিতির চাপে একদিন হয়তো পরস্পরকে ভুলে যেতাম। এখন আর ভোলার সম্ভাবনা নেই। অন্তত আমার পক্ষ থেকে।
নন্দিনী স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। তারপর কী ভেবে যেন বলল, হামিদাকে আমি জিততে দেব না কবি। আমার কপালে যাই থাক এই মুক্তির লড়াইয়ে একটা যোগ্য ভূমিকা আমাকে নিতেই হবে। ট্রেনিং পিরিয়ডটা যত কষ্টকরই হোক আমি তাতে সফল হয়ে তোমার কাছে ফিরে আসব। তোমার কাছে অনুরোধ, এই যুদ্ধটাকে তুমি অবহেলা কর না। বল করবে না?
আমি হেসে বললাম, যদি সুখ আর নিরাপত্তার কথাই ভাবতাম তবে কী আমরা কলকাতার জীবন ছেড়ে এখানে আসতাম? আমার ব্যাপারে তুমি কিছু ভেবো না নন্দিনী। আমার প্রতিজ্ঞাও তোমার মতোই। আগে দেশের স্বাধীনতা, ঢাকায় ফিরে যাওয়া, তারপর ভাগ্যে যা আছে তা দেখা যাবে।
.
দর্শনা হল্ট স্টেশনের পাশেই রেল শ্রমিকের একটা কোয়ার্টারের দশ পনেরো জন মুক্তিযোদ্ধার একটা বৈঠকে আমাকে ও নন্দিনীকে নিয়ে নাসরিন হাজির হল। আমরা ঘরে ঢোকা মাত্রই আলী রেজা বলল, কবি সাহেব, এখানে বেশি কথা বার্তা বলা যাবে। না। পাঞ্জাবিরা কাস্টম কলোনী ও রেলকর্মচারীদের কোয়ার্টারগুলোকে গত রাত থেকে সন্দেহ করতে শুরু করেছে। মোজাফফর গ্রুপের যে দুজন আপনাদের কলোনীতে পৌঁছে দিয়ে গেছে তারা যাওয়ার সময় দর্শনা হল্টে দাঁড়িয়ে থাকা একটা মালগাড়ির ভেতর ক্যামোফ্লাজ করে থাকা দশজনের একটা পাঞ্জাবি গ্রুপের ওপর হ্যান্ড গ্রেনেড ও হালকা চাইনিজ রিকয়েললেস রাইফেল দিয়ে এ্যাটাক করে শেষ করে দিয়েছে। খুব সাকসেসফুল অপারেশন। ব্রেভো। তবে দুজনের একজনের উরুতে রাইফেলের বুলেট একটা বিঁধে গেছে। লোকটার নাম লতীফ। সাহায্যের জন্য আমাদের একটা ক্যাম্পে এসে উঠেছে। বুলেটটা আজই রিমুভ করতে হবে। আমরা নিজেরাই কাজটা করতে পারতাম কিন্তু স্পটেই লতীফের খুব রক্তপাত হওয়াতে সে খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছে। একজন ডাক্তার চুয়াডাঙা থেকে আজই নিয়ে আসতে হবে। এ অবস্থায় আমরা আর দেরি করতে পারছি না। কমরেড চক্রবর্তীকে কমরেড আলতাফ ও কমরেড হাসান এই মুহূর্তেই আমাদের সীমান্তের ওপারের ক্যাম্পে নিয়ে যাবে। আর কবি সাহেব আপাতত আমার সাথে থাকুন।
আলী রেজার কথায় দুজন লোক উঠে দাঁড়িয়ে নন্দিনীর দিকে হাত বাড়িয়ে করমর্দন করল। এবং তাকে তাদের পেছনে যেতে বলে ঘরের বাইরে পা বাড়াল। নন্দিনী মুহূর্তের জন্য একটু অসহায়ের মতো আমার দিকে তাকালেও, পরমুহূর্তেই তার মুখে প্রতিজ্ঞার দৃঢ়তা ফুটে উঠল।
কবি, আমি যাচ্ছি।
আমার মুখ দিয়ে অকস্মাৎ যেন ছিটকে বেরিয়ে গেল, খোদা হাফেজ নন্দিনী।
নন্দিনী দুজন কমরেডের সাথে কোয়ার্টারের বাইরে চলে গেলে আলী রেজা আমাকে বললেন, ট্রেনিং পাওয়ার আগেই আপনাকে অপারেশন শুরু করতে হচ্ছে কবি সাহেব। এখনই একজন ডাক্তারের জন্য আপনাকে চুয়াডাঙ্গা যেতে হচ্ছে। আমি আপনাকে যে ঠিকানা দেব সেখানে গেলে তারা আপনাকে একজন সার্জারীর ছাত্র ডাক্তারকে আপনার সাথে দেবে। তাকে নিয়ে আপনি এখানে এই কোয়ার্টারের তিন নং প্লটে ফিরে আসবেন। চলুন আপনাকে সব বুঝিয়ে স্কুটারে তুলে দিচ্ছি।