নাসরিনের কথায় আমরা সামনের ঘরে এসে বিছানায় উঠলাম। নন্দিনী মশারি গুঁজতে লাগল। নাসরিন একটু পরেই এসে বাতি নিবিয়ে দিয়ে গেল। বাতি নেভাবার আগে আমাদের খাটের দিকে তাকিয়ে তার লাজুক মিষ্টি হাসি আমি মশারির ভেতর থেকেও এক ঝলক চকিতে দেখতে পেয়ে সংকোচিত বোধ করলাম। আলী রেজার কথায় একটু আগেই বুঝেছি আমরা যে স্বামী-স্ত্রী নই আলী রেজারা কীভাবে যেন আগেই আন্দাজ করে নিয়েছিল। পরে অবশ্য আমাদের পরিচয় পেয়েই আলী রেজা বুঝে গেছে আমাদের মধ্যে প্রণয় থাকলেও আমরা স্বামী-স্ত্রী নই। আমাদের আলোচনা নিশ্চয়ই পাশের কামরা থেকে নাসরিনরাও শুনেছে। এখন এ ব্যাপারে সংকোচ করেও কোনো ফল হবে না। ভেবে আমি নন্দিনীকে বললাম, আমরা যদি এদের ট্রেনিং ব্যবস্থায় রাজি হই তবে আগামীকালই তোমাকে এখান থেকে অন্যত্র চলে যেতে হবে।
আমি আলী রেজা সাহেবের প্রস্তাবগুলো শুনেছি।
আজ রাতেই আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি।
অর্থাৎ তুমি সীমান্তের ওপারে পশ্চিমবঙ্গের একটি গ্রামে গিয়ে ট্রেনিং নেবে। আর আমি থাকব এদিকে।
আলী রেজা তো এ প্রস্তাবই তোমাকে দিয়েছিলেন। এখন তুমি ঠিক কর তুমি কী করবে?
আমাকে ছেড়ে যেতে তোমার কষ্ট হবে না?
হবে।
তবুও যাবে?
কী করব বল? আমি হামিদার কাছে পরাজিত ও ছোট হয়ে বেঁচে থাকতে পারব না।
এটা তবে স্বীকার কর, দেশের স্বাধীনতা নয় প্রতিদ্বন্দিনীর প্রতি ঈর্ষাই তোমার অবচেতন বুক জুড়ে আছে। হামিদার স্বার্থ ত্যাগ ও দেশের জন্য জীবন বাজি রাখার প্রতিজ্ঞাকে তুমি সহ্য করতে পারছ না। ভাবছ এতে তোমার হার হয়েছে।
হতেও পারে। তোমাকে আমি ভালবাসি যখন তখন তোমার বৌকে জিততে দেব কেন? অবচেতন ঈর্ষা থাকতেও পারে। আমি এখন চেতন-অবচেতন বিচার করার মতো অবস্থায় নেই।
তোমার বুকের ওপর একটু হাত রাখব?
রাখো। ব্লাউজ খুলে দেব?
না থাক। এমনি তোমার বুকে মুখে একটু হাত বুলিয়ে দিতে মন চাইছে। আমরা এখন এমন এক পরিস্থিতিতে চলে এসেছি আবার যে দেখা সাক্ষাৎ হবে এমন গ্যারান্টি কোথায়?
তাহলে আর অত ভয় কি? আজ রাতটা তোমাকে দিচ্ছি। তোমার যেভাবে খুশি নাও।
আমি আল্লাকে ভয় পাই নন্দিনী। মনে হয় এই পাওয়াটা বৈধ বা ন্যায়সঙ্গত হচ্ছে না। কোথায় একটা সীমাকে লঙ্ঘন করে যাচ্ছি। এদিকে কামনায়, লোভে আমার বুকের পশম পর্যন্ত কাঁপছে। আমিও তো পুরুষ। আমি আর পারছি না।
আল্লার ভয় নয়। হামিদার ভয়ে তুমি কাঁপছ।
আল্লাহ যদি হামিদার রূপ ধরে আমার বিবেকের ওপর দৌরাত্ম্য করে তবে আমি কী করব নন্দিনী?
আমি বালিশে মুখ রেখে ফোঁপাতে লাগলাম। নন্দিনী হঠাৎ বিছানায় উঠে বসে আমার বুকে মুখে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। আমি একটু শান্ত হলে আমার দিকে পেছন রেখে ঘুমিয়ে পড়ল। আমি কী করব বুঝতে না পেরে বিছানায় উঠে চুপচাপ খোলা জানালার দিকে তাকিয়ে বসে থাকলাম। সারা কলোনীটা জুড়ে ঝিঁঝির একটানা শব্দ উঠছে। আমি মশারির ভেতর থেকেই এর স্বচ্ছ হালকা আবরণ ভেদ করে আকাশের তারা দেখতে পাচ্ছিলাম। শেষ প্রহরের পাখিরা এবং কলোনীর গৃহস্থদের মোরগ বাক দিয়ে উঠল। আমি নন্দিনীর খোঁপাভাঙা বিপুল কেশরাশিকে বালিশের ওপর দিকে সাজিয়ে দিয়ে আবার নিজের বালিশে শুয়ে পড়লাম যদিও জানি আজ আর ঘুম আসবে না। ওদিকে নাসরিনের ঘুমের আবছা আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। একবার ভাবলাম এ অবস্থা থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হল নিঃশব্দে দুয়ার মেলে এ ঘর থেকে যেদিকে দুচোখ যায় পালিয়ে যাওয়া। কিন্তু কোথায় যাব? তাছাড়া আমি তো নন্দিনীকে কথা দিয়েছি, এই যুদ্ধের সময়টা আমি তাকে একা ফেলে কোথাও যাব না। এখন কী নন্দিনী একা? আগামীকালই সে আবার নতুন পরিবেশে নতুন একদল উদ্যমী মানুষের মধ্যে ট্রেনিং নিতে চলে যাচ্ছে। আমিও এখানে অন্য একটি ক্যাম্পে অন্যদের মধ্যে আধুনিক গেরিলা যুদ্ধের কলাকৌশল শেখার জন্য চলে যাব। নন্দিনীর সাথে কী আর সত্যি আমার দেখা। হবে? আজ একটু আগেই তো সে তার সর্বস্ব আমাকে উজাড় করে দিয়ে তৃপ্ত করতে চেয়েছিল। আমি নিতে পারছি না কেন? যুদ্ধের ময়দানে এই নারী কী সত্যি আমার জন্যে অবৈধ? আমি যদি আজ এখান থেকে পালিয়ে হামিদার কাছে চলে যাই সেকি আমাকে কাপুরুষ, দেশদ্রোহী ভাববে না? আর আমি ঢাকায় গিয়ে কোথায় হামিদা নাম্নী এক মুক্তিযোদ্ধাকে খুঁজে পাব? এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই সকালের আলো এসে আমার মুখের ওপর পড়ল। পাশের ঘর থেকে নাসরিনের জেগে ওঠার শব্দও পেলাম। আমি আর শুয়ে থাকতে না পেরে তার নাম ধরে ডাকলাম, নাসরিন?
আপনারা জেগেছেন?
আপনারা নয়, আমি জেগেছি নাসরিন।
উঠে হাতমুখ ধোন। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি চা নাস্তা দিচ্ছি।
আড়মোড়া ভেঙে জবাব দিল নাসরিন।
আমি বললাম, সকাল বেলা আমার চায়ের খুব বদ অভ্যেস। নাস্তার আগেই এককাপ বেডটির মতো হবে না নাসরিন?
কেন হবে না। একটু সবুর করুন এক্ষুণি দিচ্ছি।
বলল নাসরিন।
আমি বিছানায় বসে সকালের আলোয় ঘুমন্ত নন্দিনীর ছড়িয়ে যাওয়া কেশরাশি, মুখের ঈষৎ বিবর্ণ ক্লান্তি এবং শারীরিক ক্লান্তির নারীসুলভ সৌন্দর্য চোরের মতো দেখে নিতে লাগলাম। তার নাকের বা পাশে মাছির মতো একটা বড় তিল যেন তার সরলতার সাক্ষ্য দেবার জন্য জ্বলজ্বল করছে।