আয়েসের সাথে সিগ্রেটের টান দিয়ে জবাব দিলাম।
আপনার সঙ্গিনী কী আপনার স্ত্রী?
একথা কেন বলছেন?
আমরা বুঝতে পারি। না হলেও আমাদের কোনো ক্ষতি নেই। তবে আপনাদের আসল পরিচয় এবং সম্পর্কটা আমার এবং আমার পার্টির জানা থাকা দরকার, কারণ আপনারা আমার শরণার্থী হলেও আমাদের পার্টির অশেষ উপকার করেছেন। আপনাদের নির্লোভ মানসিকতা আমার কাছে একধরণের বৈপ্লবিক বিস্ময়। এই মহিলার সত্যিকার পরিচয় আমরা নথিভুক্ত করব। আমি আশা করি আপনারা আত্মপরিচয় গোপন করে সেই সৌভাগ্য থেকে অযথা নিজেদের বঞ্চিত করবেন না। আপনার নাম শুনে মনে হচ্ছে আপনার কবিতা আমিও পড়েছি। আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতি করলেও আকাট মুখ নই।
হাসলেন আলী রেজা।
আমার নাম নন্দিনী চক্রবর্তী। ভৈরব বাজারে বাড়ি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার ছাত্রী।
নন্দিনী কখন যে ধোয়ামোছার কাজ সেরে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতে পারি নি। আমি ও আলী রেজা মুখ তুলে তার দিকে তাকালাম। সে তখন হাসিমুখে আঁচল দিয়ে হাত মুছছে।
আলী বললেন, আপনি বসুন।
নন্দিনী খাবার টেবিলের খালি চেয়ারটায় বসল।
এখন মুস্কিল হল আপনাদের ট্রেনিং পিরিয়ডে আপনারা একসাথে থাকার জিদ ধরবেন না। তেমন গ্যারান্টি দেয়া আমাদের পক্ষে সম্ভবও হবে না। কারণ আপনাদের যে ক্যাম্পে পাঠাব বলে ভাবছি তা দেশের ভেতরের একটা ক্যাম্প। সেখানে কোনো মহিলা কমরেড আমাদেরই নাই। কবি সাহেবকে কাল সকালেই সেখানে চলে যেতে হবে। আর মিস চক্রবর্তী, আমি জানি না আপনারা বিবাহিত কিনা, সেজন্য মিস বললাম। আপনাকে আমাদের ভারত সীমান্তের ভেতরের একটি গ্রামে যেতে হবে। সেখানে আমাদের ক্যাম্পে কয়েকজন মেয়ে আছেন। আপনাদের প্রাথমিক ট্রেনিং শেষ হলে আবার এখানে ফিরে আসতে হবে। পরের ব্যবস্থা আমরা স্থির করব। আমরা অবশ্য আপনাদের এখানে ফিরে এলে আমাদের পার্টির বিয়য় এবং লিটারেচার সম্বন্ধে জ্ঞাত করব। গ্রহণ করা না করা আপনাদের ইচ্ছা। এতে মুক্তিযুদ্ধে পার্টিসিপেশন আটকাবে না। আপনারা কী কমরেড তোহার নাম শুনেছেন?
আমি বললাম, তার সাথে একদা আমার পরিচয় ও আন্তরিকতা ছিল! কয়েকবার আমি তাকে আমার ঢাকার বাসায় শেলটারও দিয়েছি।
ভেরি গুড।
হাসলেন আলী রেজা।
নন্দিনী বলল, আমিও কমরেড তোহার নাম শুনেছি। চট্টগ্রাম থাকতে শুনতাম তিনি নোয়াখালীর চরাঞ্চলে কৃষকদের সংগঠিত করছেন।
আপনারা সচেতন মানুষ। আপনাদের সাহায্য আমাদের একান্ত দরকার। রাজনৈতিক মতপার্থক্য এখন মুক্তিযুদ্ধে বাধা হবে না। আজ রাতটা একটু ভালো করে ভেবে দেখুন। যদি আমার প্রস্তাবে রাজি থাকেন তবে আগামীকালের মধ্যে আপনাদের দুজনকে দুজায়গায় ট্রেনিংয়ের জন্য চলে যেতে হবে। বাকি রাতটা শান্তিতে ঘুমোন। নাসরিন আপনাদের সাথে থাকবে। সকালে ব্রেকফাস্ট সারা হলে নাসরিন আপনাদের আমার কাছে নিয়ে যাবে।
কথা শেষ করেই আলী রেজা পাশের ঘরে তার অন্যান্য সঙ্গীদের কাছে চলে গেলেন। একটু পরেই পাশের ঘর থেকে আলী রেজাদের বেরিয়ে যাওয়ার শব্দ পেলাম। একই সঙ্গে নাসরিন এসে আমাদের ঘরে ঢুকল। মুখখানা হাসি হাসি। এতক্ষণ নাসরিন মেয়েটির ছবি সুরৎ ভালো করে লক্ষ করার ফুরসৎ পাই নি।
এখন দেখলাম মেয়েটি বেশ দীর্ঘাঙ্গী। তবে চেহারায় কিশোরীসুলভ চপলতা। চোখ দুটি বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। কালো এবং গভীর। গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যাম। মাথার দুদিকে দুটি লম্বা বেণী। ডানদিকের সুরেখার ঠিক ওপরে একটা হালকা ক্ষতচিহ্ন থাকায় মনে হয় দুটি রেখা বুঝি মেয়েটির চোখের উপর কেউ ভুল করে বসিয়ে দিয়েছে। কিশোরী হলেও নাসরিনের বুকের গঠন পরিপূর্ণ, নিখুঁত। নাসরিন গাঢ় সবুজবর্ণের সালোয়ার কামিজ পরে আছে।
আমি হেসে বললাম, এসো কমরেড নাসরিন। এবার তোমার সাথে একটু কথা বলি। কিছুক্ষণ আগে তুমি যেমন সামরিক কসরৎ দেখালে তাতে একটু ঘাবড়ে গেলেও এখন ভয়টা একটু কমেছে।
আমাকে আপনাদের ঘুমের ব্যবস্থা ছাড়া আর কোনো বাড়তি দায়িত্ব দেওয়া হয় নি। সামনের ঘরে গিয়ে দুজন চুপচাপ শুয়ে পড়ুন। কাল কথা হবে।
হেসে নাসরিন এসে নন্দিনীর হাত ধরল।
নন্দিনী বলল, তোমার মা বুঝি এখানে থাকেন না?
আম্মা ছুটিছাটায় এখানে এসে থাকলেও, বেনাপোলেই বেশি থাকেন।
তোমার আব্বা?
নন্দিনীর প্রশ্নের জবাবে নাসরিন বলল, আব্বা চাটগাঁর কাস্টম ট্রেনিং সেন্টারের কোর্স কো-অর্ডিনেটর। মাঝে মধ্যে এলেও মার সাথে বেনাপোলেই থাকেন। মাঝে মধ্যে আমাকে দেখতে এখানে আসেন। আমি একাই এখানে থাকি। এবার চুয়াডাঙ্গা কলেজ থেকে আই. এ. পরীক্ষা দেব।
আমি বললাম, নাসরিন তুমি খুব অল্প বয়েসেই রাজনীতির সাথে জড়িয়ে গেছ। একথা তোমার আব্বা আম্মা জানেন না নিশ্চয়ই?
কেন জানবেন না। রাজনীতিটা আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্য। আমি যে পলিটিক্স করি আমার বাপ মাও এই আদর্শেরই সমর্থক। তবে সরকারি কর্মচারী বলে তারা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারেন না।
তোমরা কী ভাব বাংলাদেশে সাম্যবাদী দলের আদর্শই সঠিক?
আমাদের তো তাই বিশ্বাস। যাক এখন আর রাজনীতির আলোচনা নয়। আপনারা সামনের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ুন। দুজন এক ঘরেই থাকবেন তো?
আজ রাতটা অন্তত থাকি।
হাসল নন্দিনী।
মশারি টাঙানো আছে। খাটে উঠে শুধু চারধারটা একটু গুঁজে দিন। আমি গিয়ে বাতি নিবিয়ে দিয়ে আসব।