মাঝির দাবি সকলেরই কানে ঢুকলেও কেউ কিছু বলছে না। বলবেই বা কি, সকলেই প্রবল বর্ষণের মধ্যে দাঁড়িয়ে কাউয়ার মতো ভিজছে। টাকাটা অবশ্য দিনের বেলায় নদীতে থাকতেই শোধ করে দেওয়া উচিত ছিল। এখন বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে গাট্টিবোস্কা খোলার যেন কারো কোনো শক্তি বা বা প্রবৃত্তি নেই।
আমি বললাম, আপনারা একটু কষ্ট স্বীকার করে মাঝির টাকাটা দিয়ে দিন। বেচারা গরিব। আমাদের জন্য যথেষ্ট রিস্ক নিয়েছে। আপনারা ভাড়ার ব্যাপারে যে যেই কথাবার্তা বলে এনেছেন এখন তা শোধ করে দিন। আমরা এখানে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। সামনে এগোব।
আমার কথায় কাজ হল। বৃষ্টির তোড় ও মিশমিশে অন্ধকারের মধ্যেও অস্পষ্ট ছায়ামূর্তিগুলোর একটু নড়ে ওঠার আভাস পেলাম। যেন এই আতংকের মুহূর্তে তারা কারো আদেশেরই অপেক্ষা করছিল। মানুষ সর্ব অবস্থায়ই সম্ভবত একটা নেতৃত্ব কামনা করে। একটা কণ্ঠস্বর শুনতে চায় যা অপেক্ষাকৃত প্রবল এবং নির্ভরশীল।
আন্দাজে একে একে সকলেই ভাড়ার টাকা হাতড়ে হাতড়ে আমার হাতে খুঁজে দিতে লাগল। আমি অভিভূত হয়ে অন্ধকার আর বৃষ্টির ঝরঝরানির মধ্যে এইসব বিপদগ্রস্ত ও মৃত্যু তাড়িত মানুষের সততায় মুগ্ধ হয়ে থাকলাম। আমার হাতের ভেতর টাকাগুলো ভিজতে লাগল। নন্দিনী আমার বাঁ দিক থেকে বলে উঠল, এই নিন। এখানে দুশোর দুটি নোট আছে। ভাংতি খুঁজে পাচ্ছি না। মাঝিকে দিন।
আমি এগিয়ে গিয়ে মাঝির হাতে টাকাগুলো তুলে দিলাম। নিজের পকেট থেকেও একশোর একটি নোট।
আশাকরি এখানে যা আছে তাতে হিসেবে কম পড়বে না। যদি কিছু কম হয় আমাদের মাফ করে দিও।
আল্লাহ আপনেগো সহিসালামতে পৌঁছাক। আমরা গিয়া নাও ভাসাই। আয়রে বাজান।
মাঝি তার ছেলেটিকে হাতড়ে খুঁজে পেয়ে পাড়ের ঢালুতে নেমে গেল। আমরা অন্ধকারে বৈঠার শব্দ শুনতে পেলাম।
আমরা লাইন বেঁধে এক জনের পেছনে একজন এভাবে হাঁটছিলাম। যদিও ভোর হয় নি তবে বৃষ্টিটা ধরেছে। মনে হয় এখন ইলশেগুঁড়ির মত ঝরছে। আমাদের সবার চোখও অন্ধকারের মধ্যে খানিকটা অভ্যস্ত হয়ে এসেছে। পথ দেখতে না পেলেও গাছপালা বা ঝোপজঙ্গলের ওপর গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়তে হচ্ছে না। আমি সবার আগে। আকাশের পাখির ঝাঁকের সর্দার পাখিটির মতো। আমার পেছনে সীমা আমার বেল্ট ধরে। তারপর নন্দিনী বোনের শাড়ির খুঁট আঙুলে জড়িয়ে হাঁটছে। এভাবেই পুরো দলটা একের কাপড় ধরে অন্যে।
এটাই পথ কিনা জানি না, তবে পায়ের তলার মাটি, কাদা ও পানিতে ভয়ানক পিচ্ছিল। এখানকার লালমাটি বৃষ্টিবাদলে ভিজলে এমনিতেই হাঁটা মুস্কিল। আর চলছি পায়ে হাঁটা পথের হদিস হারিয়ে। আমি পা টিপে ভর রেখে এগোতে পারলেও সীমা পা পিছলে বার বার পড়ে যাচ্ছিল। সাথে নন্দিনীও। কোমরের বেল্টে হেঁচকা টান পড়লেই আমি বুঝতে পারতাম সীমা হুমড়ি খেয়েছে। বেল্টটা ছুটে গেলে আমি আবার হাত ধরে দাঁড় করিয়ে দিই।
এভাবে ঘন্টাখানেক চলার পর হঠাৎ একটা মাঠের মতো ফাঁকা জায়গায় এসে দাঁড়ালাম। মনে হল ছেলেদের খেলার মাঠ। মাঠে ঢোকার আগে আমি একটু দাঁড়ালাম। পোশাকআশাক বৃষ্টির পানিতে এখনও সপসপ করছে। মাঠের ভেতর থেকে বাতাসের ঝাপটা এসে আমার গায়ে লাগাতে হঠাৎ শীত করতে লাগল। আমি পেছন ফিরে বললাম, আমরা যদি ঠিকমতো এসে থাকি তবে বর্ডারের খুব কাছাকছি এসে গেছি। আপনারা কেউ হল্লাচিল্লা করবেন না। আমরা সামনের এই ফাঁকা জায়গাটায় ভোর না হওয়া পর্যন্ত বিশ্রাম নেব। মনে হচ্ছে এটা কোনো গাঁয়ের খেলার মাঠ। সামনে যে গাছপালার মতো দেখা যাচ্ছে এর আড়ালে নিশ্চয়ই মানুষের বাড়িঘর আছে। এসব এলাকার লোকজন ভালো নয় বলে জানি। আমরা ইণ্ডিয়ায় যাচ্ছি শুনলে লুটতরাজ করে সব কেড়ে নেবে। ধরিয়েও দিতে পারে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আকাশ একটু খুললেই গাঁটা পেরিয়ে যাব। মানুষজন জাগার আগেই। আপনারা আমার পেছনে কথাবার্তা না বলে এগোন।
সীমা বলল, দাদা, যদি গাঁয়ের মানুষ বদলোক হয়ে থাকে তবে তো ভয়ের কথা। চলুন না কষ্টেসৃষ্টে গাঁটা পার হয়ে যাই।
আমি বললাম, এই গাঁ পেরুলেই যে ইণ্ডিয়ান বর্ডার পাব এটাতো জানি না। একটু ফর্সা হলে এলাকাটা সম্বন্ধে আমরা একটা ধারণা পাব। হয়তো আমরা বর্ডারের খুব কাছেই আছি। কিংবা এর মধ্যেই বর্ডার পেরিয়ে ত্রিপুরার ভেতরে চলে এসেছি। একটু সকাল না হলে আর এগোনো ঠিক হবে না।
আমার কথা শুনে পেছন থেকে সকলে একবাক্যে সীমার কথার প্রতিবাদ করল, না আমরা মাঠে একটু জিরাবো। আর চলতে পারছি না বাবা।
আমি দলটাকে নিয়ে মাঠের মাঝামাঝি চলে আসা মাত্র সামনের গাছপালার ভেতর থেকে আচমকা একটানা গুলীর শব্দ ফেটে পড়ল। আমি মুহূর্তমাত্র হতভম্ব না থেকে চীৎকার করে বললাম, শুয়ে পড়ুন, শুয়ে পড়ুন। আপনারা শুয়ে পড়ুন। নন্দিনী, সীমা–
আমার মাটিতে লুটিয়ে পড়া শরীরের ওপর মেয়ে দু’জন হুমড়ি খেয়ে পড়ল। সীমা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল, দাদা, আমাদের বাঁচান। আমাদের ফেলে রেখে চলে যাবেন না।
আমি সীমার কানের কাছে মুখ রেখে বললাম, ভয় নেই, আপনাদের ফেলে পালাব না।
আমার কথা নন্দিনীরও কানে গেল সে আমাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরল, আমাদের ফেলে পালালে ভগবানের কাছে দায়ি থাকবেন। নদীর ঘাটে আমি আপনার কে হই যেন বলেছিলেন, মনে রাখবেন। আমি আপনাকে ঠিকই চিনেছিলাম, আপনি কবি সৈয়দ হাদী মীর। আপনার সব বই আমার কাছে আছে, জানেন? আমিও লিখি।