সম্পূর্ণ ঘটনাটা আমি সংক্ষেপে বললাম।
যিনি ব্যাগটা আপনাদের কাছে দিয়েছিলেন তার কী হল?
সশস্ত্র ব্যক্তিদের অন্য একজন পাশ থেকে আমাকে প্রশ্ন করল। আমি মুখ তুলে এবার এদের সবার দিকে তাকালাম। এরা নাসরিনসহ পাঁচজন। মেয়েটি ছাড়া সবার পরনেই খাকি পোশাক ও মাথায় মাংকি ক্যাপ। সকলেরই বয়েস ত্রিশ-পঁয়ত্রিশের মতো। এদের মধ্যে একজন বলিষ্ঠ ব্যক্তির দাড়িগোঁফ আছে। মনে হল ইনিই লীডার।
আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম, আমরা প্লেনের জানালা দিয়ে তাকে ধরে নিয়ে যেতে দেখেছি। সিকিউরিটি গার্ডরা তাকে ঠেলে এয়ারপোর্টের ভেতরের দিকে নিয়ে যেতে দেখেছি। তারপর আমরা আর তার সম্বন্ধে কিছু জানি না।
আমার জবাব শুনে এরা পরস্পর মুখ চাওয়া চাওয়ি করল। নন্দিনী এ অবস্থায় খাওয়া আর সম্ভব নয় ভেবে গেলাস তুলে হাত ধুয়ে ফেলার উপক্রম করতে দাড়িওয়ালা লোকটি বলল, আপনারা খাওয়া শেষ করুন। পরে আলাপ করব। ভয় পাবেন না।
তার কথায় আশ্বস্ত হয়ে আমরা আবার খাওয়া শুরু করলাম। নাসরিন এগিয়ে এসে আমাদের পাতে ভাত বেড়ে দিতে লাগল।
০৮. মুক্তিযোদ্ধার সামনে আমরা
প্রকৃতপক্ষে এতগুলো মুক্তিযোদ্ধার সামনে আমরা আর ঠিকমত লোকমা তুলতে পারছিলাম না। নন্দিনী তো ভাতের বাসনের ওপর কেবল আঙুল বুলিয়ে খেলছিল। যদিও নাসরিন তার ভাতে ডাল ঢেলে দিতে দিতে বলল, খান। আপনি বুঝি আমাদের চাল ডাল বের করে চট করে রেঁধে নিয়েছেন?
কী করব বল, খিদের জ্বালায় মরে যাচ্ছিলাম।
খুব ভাল করেছেন। তবে এখন আমরা আসাতে আর খেতে পারছেন না। খান, কোনো বদ মতলব না থাকলে আমরা আপনাদের ক্ষতি করব না।
অভয় দিয়ে নাসরিন হাসল। মনে হয় সে আমাদের সাথে কিছুক্ষণ আগে যে আচরণ করেছে সেটার জন্যে সামান্য অনুতপ্ত।
আমাদের কোনোই বদ মতলব নেই নাসরিন। আমরা টাকাটা ফেরত না দিলেও পারতাম। তোমরা কোনোদিন জানতেও পারতে না টাকাটা কার হাতে পড়েছে। তোমাদের যে লোক ব্যাগটা আমার হাতে দিয়েছিলেন তিনি আমাদের নামধাম বা পরিচয় জানতেন না। এ টাকায় আমরা কলকাতায় এই যুদ্ধের মধ্যে আরামে দিন কাটাতে পারতাম। আমাদের বিবেক ও দেশের প্রতি কর্তব্যবোধই এখানে টেনে এনেছে। তোমরা এখন আমাদের নিয়ে কী করবে তা তোমাদের ব্যাপার। আমরা তোমাদের সাথে দেশের জন্য লড়ব বলে এখানে এসেছি।
নন্দিনীর কথায় অস্ত্রধারীরা পরপর মুখ চাওয়া চাওয়ি করল। দাড়িঅলা লোকটি যেন একটা ইঙ্গিত করা মাত্রই দলের অন্যেরা তাক করা অস্ত্রের নল আমাদের দিক থেকে নামিয়ে ফেলল।
দাড়িঅলা লোকটি বলল, আপনারা কী আমাদের সাথে থাকতে চান?
আপনারা যদি বিশ্বাস করে আমাদের আশ্রয় দেন তবে আমরা থাকতেই এসেছি।
জবাব দিলাম আমি।
আপনাদের কোনো সামরিক ট্রেনিং আছে?
দাড়িঅলা লোকটি আবার প্রশ্ন করল।
না। বলল নন্দিনী।
আমাদের সাথে থাকতে হলে আপনাদের ট্রেনিংটা নিতে হবে।
আমি বললাম, আমরা এ ব্যাপারে প্রস্তুত হয়েই এসেছি। এখন আপনারা যদি আমাদের বিশ্বাস করেন তবে আমাদের গ্রহণ করতে পারেন। কলকাতায় ফিরে যেতে চাই না। আপনার নামই কী আলী?
আমার প্রশ্নে দাড়িঅলা লোকটি একটু চমকে গিয়ে তার সঙ্গিদের দিকে তাকাল। নাসরিণ প্রশ্ন করল, আপনারা এ নাম কোথায় জানলেন?
নন্দিনী বলল, ব্যাগটায় টাকার সাথে যেসব কাগজপত্র ছিল সেখানেই আমরা তোমাদের নাম ও আলী বলে একজনের নাম পেয়েছি।
এবার দাড়িঅলা লোকটি বলল, আমার নামই আলী। আলী রেজা। আমি আপনাদের এত ঝুঁকি নিয়ে এখানে এসে টাকাটা পৌঁছে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমাদের পার্টির আদর্শের সাথে আপনাদের পরিচয় না থাকলেও আমরা আপনাদের আশ্রয় দেব। তবে এখানে আমাদের ট্রেনিং ক্যাম্প একেবারে ভারত সীমান্তের কাছে। সেখানে কমপক্ষে একমাস আপনাদের থাকতে হবে অত্যন্ত কষ্টের মধ্যে। জনমানবহীন একটা পরিত্যক্ত গ্রামে আপনাদের থাকতে হবে। ঠিকমত খাবার জুটবে না। হানাদাররা সার্চ করতে গেলে পশ্চিমবঙ্গের একটা গ্রামে গিয়ে থাকতে হবে। সেখানেও একটা ট্রেনিং ক্যাম্প আমরা চালু করেছি। ট্রেনিং শেষ হলে সরাসরি আপনাদের খুলনা, যশোর, কিংবা ঢাকায় গিয়ে গ্রুপ লীডারের নির্দেশে কাজ করতে হবে। ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। আজ রাতটা একটু ভেবে দেখুন। যদি রাজি থাকেন তবে কাল আমাদের জানাবেন। আর যদি আবার কলকাতায় ফিরে যেতে চান তবে আমাদের লোকজন আপনাদর পৌঁছে দেবে।
কথাগুলো বলে আলী রেজা তার সঙ্গীদের দিকে তাকাল। বলল, তোমরা গিয়ে বৈঠকখানায় অপেক্ষা কর।
নাসরিনসহ অন্য তিনজন কোনো কথা না বলে সামনের কামরায় চলে গেল। আমাদেরও খাওয়া শেষ। হাত ধুয়ে মুছে আমি আলী রেজার সামনে এসে বসলাম। নন্দিনী থালা বাসন নিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকল।
আমি ধীরে সুস্থে পকেট থেকে সিগ্রেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগ্রেট আলী রেজাকে দিলাম। তিনি সিগ্রেটটা নিতে নিতে হেসে বললেন, এখানকার মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন খুবই কষ্টকর। অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। পলিটিক্যাল মোটিভেশন না থাকলে দেশের ভেতরে থেকে যুদ্ধ করা আরও মুস্কিল। আপনাদের খুব ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এবার আপনার ও আপনার সঙ্গিনীর পূর্ণ পরিচয় আমাকে বলুন।
আমার নাম সৈয়দ হাদী মীর। আমার স্থায়ী ঠিকানা অর্থাৎ জন্মস্থান ব্রাহ্মণবাড়িয়া। পাকিস্তান আর্টস কাউন্সিলের গ্রন্থাগার পরিচালনা করতাম। কবিতা লেখারও চেষ্টা করি।