বলল নন্দিনী।
আমি বললাম, আমি কিন্তু তোমার মতো নিশ্চিন্ত হতে পারছি না। আমরা এখন যাদের আওতায় এসেছি তারা স্বাভাবিক মুক্তিযোদ্ধা নয়। এরা আন্ডারগ্রাইভে থেকে বহুদিন আগে থেকে স্থানীয় শোষক-পুঁজিপতি ও সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ এবং সম্প্রসারণবাদের সাথে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের সাম্প্রতিক মুক্তির লড়াই এদের জন্য নতুন মাত্রা যোগ করেছে মাত্র। এরা যে আমাদের বন্ধুভাবে নেবে তা আগে থেকেই আন্দাজ করে বসে থেকো না। এরা সহজে আমাদের বিশ্বাস করবে না।
এখন ভাগ্যের ওপর ভরসা করা ছাড়া আর উপায় কী?
আমার খুব খিদে পেয়েছে নন্দিনী।
তবে তো বাতিটা জ্বালতে হয়। খুঁজলে নিশ্চয়ই কিছু খাবার জুটে যাবে। দেশলাইটা দাও আমি সুইচ বোর্ডটা কোনদিকে দেখি।
নন্দিনীর কথামত আমি দেশলাই তার হাতে নিলাম। বুঝতে পারলাম নন্দিনীও খিদেয় কাতর। সে কাঠি জ্বেলে দরজার পাশে সুইচবোর্ড খুঁজে পেয়ে বাতি জ্বালাল। বেশ পরিপাটি করে সাজানো একটা মধ্যবিত্ত চাকুরিজীবীর কোয়ার্টার বলেই ধারণা হল। আলনায় পরিপাটি করে সাজানো রংবেরঙের শাড়ি ব্লাউজ জুতো। একটা বুক সেলুফে বেশকিছু বইপত্র। ড্রেসিং টেবিলের পাশে একটা বাঁধানো ফটোগ্রাফ। ছবিতে একজন মধ্যবয়ক শুল্ক বিভাগে কর্মরত মহিলার সাথে একটা চৌদ্দ-পনেরো বছরের কিশোরী দাঁড়ানো। ছবি দেখে মনে হয় উভয়েই বেশ ফর্সা। কিশোরীটির মুখমণ্ডল চিবুকের দিকে একটু লম্বমান। বেশ সুন্দর চেহারা। সম্ভবত এই মেয়েটি নাসরিন। পাশের মহিলাকে কাস্টমস-এর পোশাকে বেশ স্মার্ট বলেই মনে হল। মহিলা খুব দীর্ঘাঙ্গীই হবেন। মেয়েটিকে সামনে রেখে দুই কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছেন। মা মেয়ে দুজনেই হাসিমুখ।
নন্দিনী ততক্ষণে খাবার আলমারিটা তন্ন তন্ন করে দেখছে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কিছু পেলে?
ভাতের ডেগ ধোয়ামোছা। তবে প্রচুর ডাল পড়ে আছে। আর একটা সরায় গোটা চারের মুরগির ডিম। একটা ব্যাগে চাউলও আছে। চুলাটা খুঁজে পেলে ভাত চাপিয়ে দিতে পারতাম।
হেসে বলল নন্দিনী।
আমি হেসে বললাম, তাড়াতাড়ি রান্নাঘর খুঁজে বের করে। তোমার কথা শুনে খিদে আরও বেড়ে যাচ্ছে। নিশ্চয়ই এদিকে কেরোসিনের চুলোয় রাঁধা হয়। রান্না ঘরটা খুঁজে পেলে সব পাবে। জান তো কাল সকালে যাদের পাল্লায় পড়ব তারা কেমন আচরণ করবে তা এখনই আঁচ করা যাচ্ছে না। হয়ত কয়েকদিন খেতেই দেবে না।
আমি কিন্তু একটুও ভয় পাচ্ছি না। যারা নিঃস্বার্থভাবে একটা অর্থের ভাণ্ডার অপরিচিত লোকদের হাতে তুলে দেয় তাদের প্রতি জামাই আদর না করলেও প্রাণে মারবে না বলেই ভরসা করি।
ঘরের সবগুলো বাতি স্যুইচ টিপে জ্বালিয়ে দিতে দিতে জবাব দিল নন্দিনী। রান্নাঘর খুঁজতে ঘরটার পেছনে কপাট মেলে দিয়ে বলল, এই তো পেয়েছি।
রান্নাঘর?
তাই তো মনে হচ্ছে।
দাঁড়াও আমিও আসছি।
বলে আমি বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। বিছানার ওপর নাসরিনের টর্চটাও পাওয়া গেল। আমি টর্চটা হাতে নিয়ে নন্দিনীকে সাহায্য করতে এগোলাম। নন্দিনী অল্পক্ষণের মধ্যেই রান্নাঘরের চুলা চাক্কি বের করে ফেলে হেসে বলল, এখানে রান্নাবান্নার সবকিছুই মজুত আছে কবি। আমাকে আর তেমন সাহায্য করতে হবে না। তুমি বরং একটু বিশ্রাম নাও আমি দুজনের খাওয়ার মতো সামান্য চাল ফুটিয়ে আনি। আসলে আমারও পেট চো চো করছে।
অল্পক্ষণের মধ্যেই নন্দিনীর ভাত রান্না ও ডিম ভাজি হয়ে গেল। নন্দিনী বাসি ডালটাও গরম করে ডেগ শুদ্ধ টেবিলে এনে রাখল। ঘরের পাশের টিপ কল থেকে জগ ভর্তি পানিও নিয়ে এসে বলল, এসো শুরু করা যাক।
আমি টেবিলে বসতে গিয়ে হেসে বললাম, এই বোধহয় তোমার আমার প্রথম ঘরকন্না। হোক ডিমভাজি আর ডাল, অমৃত সমান লাগবে।
আমার রান্না নিয়ে আজ অন্তত ঠাট্টা করো না কবি, ভগবানের দোহাই। আমি অল্পসল্প রান্নাটা জানি। আজ এই মুহূর্তে এর পরীক্ষা নিতে চেও না। খিদেয় বুক জ্বলছে। একটু নুন মাখিয়ে হলেও চারটি ভাত পেটে পড়ুক।
নন্দিনীর কথায় আমিও লজ্জা পেয়ে হাসলাম, সত্যি অন্যায় হয়ে গেছে। এসো শুরু করা যাক। আমি গরম সসপেনে পাশাপাশি সাজিয়ে আনা দুটি ডিমভাজির একটা ভাতের প্রেটে তুলে নিলাম। নন্দিনী ধোয়া-ওড়া গরম ভাত একটা পিতলের চামচে তুলে আমার পাত ভর্তি করে দিয়েছে।
আমি নিমকদান থেকে একটু নুন তুলে নিয়ে পাতে রেখে ভাত মাখাতে লাগলাম। প্রথম লোকমা তোলার সাথে সাথেই কোয়ার্টারের প্রবেশ দরোজায় তালা খোলার শব্দ পেলাম। নন্দিনীও উৎকণ্ঠিত হয়ে শব্দটা শুনল।
দুয়ার খুলে বেশ কয়েকজন লোক ঘরে প্রবেশ করছে অনুভব করা মাত্রই কয়েকজন সশস্ত্র স্টেনগান উঁচিয়ে আমাদের খাওয়ার টেবিলটা ঘিরে দাঁড়াল। এদের পেছনে নাসরিনকেও দেখে নন্দিনী প্লেটের ওপর ভাতের গ্রাস রেখে বলল, নাসরিন এরা আমাদের কাছে কী কিছু জানতে চায়?
নাসরিন কিছু বলার আগেই একজন সশন্ত্র ব্যক্তি নন্দিনীর দিকে অস্ত্রের তাক রেখে বলল, সত্যি করে বলুন আপনারা কোত্থেকে এসেছেন?
কলকাতা থেকে।
আমি জবাব দিলাম।
এ ব্যাগটা কে আপনাদের দিয়েছে?
গোহাটি এয়ারপোর্টে এক ভদ্রলোক অনেকগুলো ব্যাগ স্যুটকেস নিয়ে কলকাতার প্লেনে উঠতে গিয়ে আমার স্ত্রীকে এই ব্যাগটা একটু ধরতে বলে তার হাতে গছিয়ে দেন। প্লেনে ওঠার সময় তিনি লাইনের পেছনে পড়ে যান। আমরা ঠিকমতোই প্লেনে উঠতে পারলেও সে ভদ্রলোক চেকিং এর মধ্যে পড়ে যান। তাকে গার্ডরা টেনে লাইনের বাইরে এয়ারপোর্টের ভেতরে নিয়ে যায়। আমরা নিরুপায় হয়ে ব্যাগটা নিয়ে কলকাতায় চলে আসি। আমার ভগ্নিপতি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের একজন বড়কর্তা বলে এবং আমরা তার পরিবারের সদস্য হয়ে আসার ফলে চেকিংয়ের ঝামেলা এড়িয়ে যেতে পারায় ব্যাগটা বেঁচে যায়। আমরা জানতাম না ব্যাগের মধ্যে কী আছে। বাসায় এনে খুলে দেখি এতে অনেক টাকা ও কাগজপত্র রয়েছে। এ টাকা যে একদল মুক্তিযোদ্ধার সম্পত্তি এটা একটা চিঠি থেকে জানতে পেরে বিবেকের তাড়নায় প্রাণ বাজি রেখে আমরা ব্যাগটা আপনাদের কাছে পৌঁছে দিতে এসেছি।