এবারকার অনুরোধে মনে হয় একটু কাজ হল। নাসরিন বলল, বাঁ দিকের জানালার কাছে সরে আসুন।
আমরা দ্রুত দরজা ছেড়ে বাঁদিকের অন্ধকার জায়গাটায় এসে দাঁড়ালাম। এখানে একটা কচুবনের ওপর সম্ভবত কোয়ার্টারের একটা জানালা আছে। আমরা এদিকটায় সরে এসে দাঁড়াতেই অন্ধকার দেয়ালের মধ্যে একটা জানালা খোলার শব্দ পেলাম। কিন্তু চোখে কিছু দেখতে পেলাম না। একটা টর্চের আলো এসে নন্দিনীকে ও আমাকে মুহূর্তের মধ্যে উদ্ভাসিত করেই নিবে গেল। আকস্মিক আলোর কম্পিত বিনিময়ের ভেতর জানালায় মেয়েটিকে স্পষ্ট না বুঝলেও তার হাতে একটা উদ্যত পিস্তলের আভাস পেলাম। মেয়েটি অর্থাৎ নাসরিন বলল, আপনারা এতরাতে কোত্থেকে এসেছেন?
আমি কিছু বলার আগেই নন্দিনী বলল, কলকাতা থেকে।
আপনারা কে?
জবাবে আমি বললাম, আমার নাম সৈয়দ হাদী মীর। আর ইনি নন্দিনী চক্রবর্তী।
আপনারা স্বামী স্ত্রী?
নন্দিনী বলল, হ্যাঁ।
কোন গ্রুপের নোক আপনারা?
আমার মাথায় চট করে একটা বুদ্ধি জোগালে আমি নির্দ্বিধায় জবাব দিলাম, আমরা নিমতার মোজাফফর গ্রুপের লোক। এই ব্যাগটায় তোমার জন্য জরুরি ম্যাসেজ আছে বলেই আমরা সুদূর কলকাতা থেকে নিমতার সালাম মাস্টারের বাড়ি হয়ে এখানে এসেছি। তুমি যদি এক্ষুনি দুয়ার খুলে না দাও আমরা বাধ্য হয় তোমার জন্যে আনা ব্যাগটা ফিরিয়ে নিয়ে চলে যেতে। যা করবার তাড়াতাড়ি কর।
অনেকক্ষণ পর্যন্ত জানালাটা অন্ধকার হয়ে থাকল। নাসরিন কোনো জবাব দিচ্ছে ।
আরও খানিকটা সময় অপেক্ষা করে নন্দিনী কোমল গলায় ডাকল, নাসরিন।
বলুন।
এই ব্যাগটায় তোমার জন্য একটা চিঠি আছে। বাতিটা জ্বালো আমি হাত বাড়িয়ে চিঠিটা তোমাকে দিচ্ছি। নাসরিন একথার কোনো জবাব না দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর কী ভেবে হঠাৎ বলল, ওদিকে আসুন দুয়ার মেলে দিচ্ছি।
আমরা আবার দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম। একটা শব্দ করে দরজা খুলে গেলে ভেতর থেকে পিস্তল হাতে একলাফে নাসরিন লাইটপোস্টের আলোয় মধ্যে বেরিয়ে এল। আমাদের দিকে পিস্তলের তাক রেখে বলল, আপনাদের সাথে কোনো হাতিয়ার থাকরে মাটিতে রেখে দিন। তাড়াতাড়ি করুন।
নাসরিনের এই আকস্মিক মুক্তিযোদ্ধাসুলভ দক্ষতায় মুহূর্তের জন্য হকচকিয়ে গেলেও আমি পরমুহূর্তে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টায় বললাম, আমাদের কাছে কোনো হাতিয়ার নেই নাসরিন। তুমি চেক করতে পার।
ঠিক আছে যে ব্যাগটা আমাদের দিতে এনেছেন তা মাটিতে নামিয়ে রাখুন।
ব্যাগটা তখন নন্দিনীর হাতে থাকায় সে নাসরিনের কথা অনুযায়ী কাজ করল। ব্যাগটা মাটিতে রাখা মাত্র নাসরিন সেটা ছোঁ মেরে নিজের হাতে তুলে নিল।
আপনারা এবার ঘরের ভেতরে যান।
আমরা তার কথামত কপাট পেরিয়ে অন্ধকার কামরার মধ্যে ঢুকে পড়লাম। নাসরিন বাইরে থেকে অকস্মাৎ দরজার দুটি পাট টেনে এনে সম্ভবত তালা মেরে দিল। টিপ তলার বন্ধ করার আওয়াজ পেলাম। সবটা ঘটনা এমন মুহূর্তের মধ্যে ঘটে গেল যে আমি ও নন্দিনী উভয়েই হতভম্ব। কিন্তু নাসরিনককে আমি বা নন্দিনী স্পষ্ট ভাবে কেউ একবারও দেখতে পারি নি। শুধু বুঝতে পেরেছি মেয়েটা বয়েসে কিশোরী হলেও বেশ লম্বা এবং শারীরিক শক্তির অধিকারিণী। হয়তো বা যুবতীই হবে। শুধু তার চেহারাটাই কোনো আলোর ঝলকের মধ্যে একবারও স্পষ্ট দেখার সুযোগ ঘটে নি। তবে গলায় আওয়াজটা খুব মিষ্টি।
নন্দিনী তার হতভম্ব ভাব কাটিয়ে অন্ধকার ঘরের ভেতর থেকে বলে উঠল, আমাদের কী আটক করলে নাসরিন?
কিছু মনে করবেন না, আপনাদের সকাল পর্যন্ত এভাবেই এখানে থাকতে হবে। আমি আমার পার্টির লোকদের কাছে ব্যাগটা নিয়ে যাচ্ছি। আপনারা যদি সত্যি কোনো ক্ষতি করতে না এসে থাকেন তবে ভয়ের কোনো কারণ নেই। আপনারা যদি শুয়ে বিশ্রাম নিতে চান তবে ঘরের ভেতর বিছানা পাতা আছে শুয়ে পড়ুন। আলো জ্বালার দরকার হলে কপাটের পাশেই সুইচ বোর্ড আছে দেশলাই জ্বেলে দেখে নিন। বেশি হই চই করে নিজেদের বিপদ ডেকে আনবেন না। এ কলোনীতে কয়েক ঘর পাকিস্তানী আছে আবার তাদের সাপোর্টারও কয়েকজন আছে। খুব সাবধানে থাকতে হবে, বুঝলেন?
নন্দিনী বলল, আমরা সবই বুঝতে পারছি নাসরিন। তুমি না ফেরা পর্যন্ত আমরা এখানেই থাকব। পালাবার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ আমরাও তোমাদের সাথেই থাকতে চাই। তোমাদের সাথে থেকে লড়তে চাই। আর একটা কথা, যে ব্যাগটা নিয়ে যাচ্চো ওতে লাখ তিনেক রূপীর ভারতীয় কারেন্সী আছে। টাকাটা তোমাদের। ব্যাগটা সাবধানে নিয়ে যেও।
ঠিক আছে, এখন চুপচাপ শুয়ে পড়ুন। আমি আমাদের লোকজনের কাছেই যাচ্ছি।
বলল নাসরিন।
আমি পকেট থেকে সিগ্রেটের প্যাকেট আর দেশলাই বের করে বললাম, আলো জ্বালছি তুমি সুইচটা কোথায় দেখে নিয়ে বাতি জ্বালো।
বাতির কী দরকার? তোমার দেশলাই থেকে আর একটা কাঠি জ্বেলে বিছানাটা কোথায় পাতা আছে দেখে নিলেই তো হয়। আমি আর দাঁড়াতে পারছি না কবি।
নন্দিনীর কথায় আমি আর একটা কাঠি জ্বালালাম। বসার ঘর ছেড়ে আমরা একটু ভেতরে গেলেই একটু সুসজ্জিত কামরা দেখতে পেলাম। এখানেই একটা বিছানা পাতা। নন্দিনী সোজা গিয়ে বিছানায় পড়ল। কাঠিটা নিবে গেলে আমিও গিয়ে বিছানায় বসলাম।
যাক আমাদের ওপর থেকে একটা গুরুভার নেমে গেল। হ্যান্ডব্যাগটা বুকের ভেতর পাথরের মতো চেপে বসেছিল। এখন যাদের টাকা তাদের হাতে পৌঁছে যাবে।