মোজাফফর ও লতিফ আমার সাথে করমর্দন করে ও নন্দিনীকে সালাম জানিয়ে বিদায় দিল। আমরাও দেরি না করে কলোনীর গেটে এসে ঢুকলাম। ঢুকেই একজন পাহারাদারের সামনে পড়ে গেলাম। নন্দিনী এ অবস্থায় একটু অপ্রতিভ না হয়ে সোজাসুজি পাহারাদারের সামনে এগিয়ে গেল, আমরা রাতের গাড়িতে যশোর থেকে এসেছি। এখানে নাসরিনদের কোয়ার্টারটা কোনো দিকে একটু দেখিয়ে দেবেন?
সশস্ত্র পাহারাদারটা সম্ভবত একটু উদাসীন। সে নন্দিনীর দিকে ভাল করে না তাকিয়েই আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, গেটে আপনাদের রিকশা থাকলে ভেতরে নিয়ে যান। দক্ষিণ সারির প্রথম বাড়িটাই নাসরিনের আম্মার। আপনারা কী রিকসা ছেড়ে দিয়েছেন?
আমি সুযোগ পেয়ে বললাম, রিকশাঅলা গেটের ভেতরে যেতে চায় না। বলে রাতে ভেতরে ঢোকা নাকি বারণ। এজন্যই তো রিকশা ছেড়ে দিলাম। এখন কী করি বলুন তো।
এখন কী আর করবেন। সোজা হেঁটে চয়ে যান। ঐযে লাইট পোস্টটা দেখা যাচ্ছে এর নিচের টিনের শেডগুলোই নাসরিনের মায়ের কোয়ার্টার। আপনারা তার কী হন?
আমি তার বোন। আর ইনি আমার স্বামী।
বলল নন্দিনী।
আপনারা যশোর থেকে এসেছেন। যশোরের খবর কী? শুনলাম সেখানে মুক্তিবাহিনী খুব মার লাগাচ্ছে?
আমি বললাম, শুনেছি তো সারাদেশেই এরা সুবিধা মতো মার লাগাচ্ছে। তবে চোখে তো দেখি নি, তাই বলতে পাচ্ছি না। বিশ্বাস করি কী করে? সব জায়গা থেকেই তো খানসেনাদের দাপটের কথা শুনছি। ঘরবাড়ি পোড়াচ্ছে, গ্রামকে গ্রাম উজাড় করে দিচ্ছে, মেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে এইসব।
আরে রাখুন সাহেব। হারামজাদা এখন মুক্তিবাহিনীর ভয়ে কাঁপছে। বেটারা নির্ঘাত হারবে। স্বাধীন বাংলা বেতার শুনছেন তো। স্কুল কলেজের ছেলেদের মার খেয়েই খান সাবরা চোখে সর্ষেফুল দেখছে। সারা দেশে একটা মানুষও এদের পক্ষে নেই। এ অবস্থায় যুদ্ধ করবে কী?
বলল পাহারাদার। বেশ খুশি খুশি ভাব। বুঝলাম এ লোক আমাদের কোনো অনিষ্ট করবে না। মুক্তিবাহিনীর কৃতিত্বে এ আনন্দিত। আমরা তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে নাসরিনদের কোয়ার্টারের দিকে হাঁটা ধরলাম।
কোয়ার্টারের সামনে এসে নন্দিনী বলল, কবি আমার বুক কাঁপছে।
আমি বললাম, এখানে এই লাইট পোষ্টটার নিচে একটু দাঁড়াও। আগেই ঠিক করে নিই কেউ দরজা খুলে দিলে কী বলবে।
যা বলতে হয় আমিই বলব। যার ব্যাগ আমরা যেহেতু তার নামটাও জানি না, শুধু একটা চিঠি পড়ে জানি টাকাটা ও কাগজপত্র এই কলোনীতে নাসরিন নামের একটি স্কুলছাত্রীকে পৌঁছে দেয়ার ইঙ্গিত আছে, এর বেশিকিছু আমরা করতে বা বলতে যাব না। এরা যদি বেশি প্রশ্ন করে তখন বলব আমরা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের ওপর ভরসা করেই টাকাটা নিয়ে এখানে এসেছি। এরা যদি সন্দেহ করে এদের বিপদে ফেলার ষড়যন্ত্র নিয়ে আমরা এখানে এসেছি, করতে পারে, আমরা কোনো জবাব দেব না।
বলল নন্দিনী।
আমি এগিয়ে গিয়ে দরজায় কড়া নাড়লাম। লাইট পোষ্টের আলো এসে দরাজায় পড়ায় সবকিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কপাটের একদিকে আলকাতরা দিয়ে ইংরেজি সেভেন সংখ্যাটি লেখা। সম্ভবত এটাই কোয়ার্টারের নাম্বার। আশেপাশের কোয়ার্টারগুলো খুব বেশি দূরে নয় পনের বিশ গজ দূরে দূরে এক একটা বাড়ি। প্রত্যেক বাড়ির সামনে এক চিলতে বাগান। গাদাফুলের ঝোপ থেকে এক ধরনের বন্য গন্ধ নাকে এসে লাগছে। কড়া নাড়ার পরও ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না দেখে আমি আবার একটু জোরে দরজার পাটে আঘাত করলাম। এবার ভেতর থেকে খুব ক্ষীণকণ্ঠে কে যেন জিজ্ঞেস করল, কে?
আমি জবাব দিলাম, দরজাটা খুলুন, আমরা আপনাদের মেহমান।
ভেতর থেকে বেশ ক্ষীণ কণ্ঠে কে যেন বলল, এতরাতে কে আপনারা? আম্মা তো বাড়িতে নেই, বেনাপোল গেছেন। দরকার থাকলে কাল সকালে আসবেন। এতরাতে আমি দুয়ার খুলব না। বাসায় আমি একা আছি। আপনারা সকালে আসবেন।
সতর্ক মেয়েলী গলা। এবার নন্দিনী এগিয়ে এসে দরজার পাশে দাঁড়াল। এবং বেশ পরিষ্কার উচ্চারণে ভেতরের মেয়েটিকে ডাক দিল, শোন নাসরিন। তুমি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?
শুনতে পাচ্ছি। কী বলছেন বলুন। আপনি কে?
আমাকে তুমি চিনবে না নাসরিন।
আমি চিনবো না, তবে আমার নাম জানলেন কী করে?
কীভাবে তোমার নাম জানলাম এটা বলতেই তো নানা বিপদের মধ্যে এতো দূর এসেছি। নাসরিন, তোমার কোনো ভয় নেই। আমরা তোমার বা তোমাদের শত্রু নই। বরং বন্ধু। তোমাদের সাহায্য করতেই এসেছি। খুব বিপদ মাথায় নিয়ে এসেছি। আমাদের এভাবে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখলে তোমাদেরই ক্ষতি হবে। আমরা তোমাকে একটা ম্যাসেজ পৌঁছে দিতে এসেছি।
খুবই অনুচ্চকণ্ঠে, বেশ আবেগ মিশিয়ে নন্দিনী কথাগুলো বলল । কিন্তু অনেকক্ষণ পর্যন্ত নাসরিনের আর সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। মনে হল নাসরিন বেশ দুঃশ্চিন্তায় পড়ে গেছে কী করতে হবে ভেবে পাচ্ছে না।
এবার আমি ডাকলাম, নাসরিন।
না, আমি এভাবে এতরাতে আপনাদের জন্য দুয়ার খুলে দেব না। আপনারা এখন চলে যান। সকালে আসবেন। তাছাড়া আপনারা কে আমি তো চিনতেই পারছি না। কোনো ম্যাসেজ থাকলে বাইরে থেকেই তো বলতে পারেন।
বেশ জেদের সাথে নাসরিন আমাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল। এবার মরিয়া হয়ে শেষ চেষ্টা করতে নন্দিনী মুখ বাড়িয়ে নাসরিনকে ডাকল, শোন নাসরিন, যদি আমাদের সন্দেহ করে দুয়ার খুলতে ভয় পাও তবে ঐ পাশের জানালাটা খুলে আমাদের সাথে একটু কথা বল। আমরা বহুদূর থেকে তোমার কাছে এসেছি। তোমাদের সাহায্য করতেই এসেছি। এখানে থাকার আমাদের কোনো পরিচিত জায়গা নেই। আমরা এখন কোথায় যাব বলতো? তুমি আশ্রয় না দিলে আমরা নির্ঘাত ধরা পড়ে যাব।