বলল একজন।
আমি আর নন্দিনী বিনাবাক্যে উঠে দাঁড়ালাম। হ্যান্ড ব্যাগটা হাতে তুলে নিয়ে বললাম, চলুন, আমরা রেডি।
রওনা হওয়ার আগে আপনাদের একটু সতর্ক করার আছে। প্রথম কথা হল পথ চলতে চলতে আমাদের কোনো প্রশ্ন করবেন না। চতুর্দিকে রাজাকার বাহিনী পাহারা বসিয়েছে। নিজেদের মধ্যে কোনো আলাপ আলোচনা চলবে না। পথে কেউ চ্যালেঞ্জ করলে আপনারা কোনো জবাব দেবার চেষ্টা করবেন না। যা বলতে হয় আমরা বলব। তেমন অবস্থায় পড়লে আপনারা আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে যাবার চেষ্টা করবেন। আমরা এখন যেদিকে হাঁটা দেব ঠিক সেদিকে নাক বরাবর হেঁটে গেলে আপনারা দর্শনা হল্ট স্টেশনে পৌঁছে যাবেন। কাউকে কোনো প্রশ্ন করার দরকার নেই। ভয় নেই, পথে কোনো চ্যালেঞ্জে না পড়লে আমরাই আপনাদের দর্শনার কাষ্টম কলোনীতে পৌঁছে দেব। পথে কোনো বিপদ ঘটলে কী করতে হবে তাই শুধু জানালাম। আমার নাম মোজাফফর। আমি এখানকার মুক্তিবাহিনীর ফ্রুপ লীডার। আর আমার সঙ্গীর নাম লতিফ, ট্রেইন্ড ফাইটার।
আসসালামু আলাইকুম।
লতিফ আমার সাথে হাত বাড়িয়ে করমর্দন করল। আমিও সালামের জবাব দিয়ে বললাম, আমরা বোধহয় আপনাদের ওপর বাড়তি বোঝার মতো চেপে গেছি।
মোজাফফর হেসে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলে বলল, বোঝা কেন হবেন। আপনারাও যতদূর জানি দেশের জন্যই বিপদ মাথায় নিয়ে দেশের ভেতর চলাফেরা করছেন। হরহামেশাই আমরা লোকদের চলাফেরায় সাধ্যমত সাহায্য করছি। আজ দুদিন ধরে শত্রুরা এই অঞ্চলে খুব সতর্ক হয়ে উঠেছে। এখানকার কয়েকটি অপারেশন পাক বাহিনী মার খেয়ে পাগলের মতো যাকে তাকে খুন করছে। রাজাকাররাও খুব এ্যালার্ট। এ অবস্থায় আপনাদের দায়িত্ব এসে পড়ায় একটু সাবধান থাকা দরকার। আচ্ছা আপনাদের কেউ হ্যান্ড গ্রেনেড ছুঁড়তে জানেন?
আমি বললাম, না আমাদের কারো গ্রেনেড ছোঁড়ার কোনো ট্রেনিং নেই। তবে শিখিয়ে দিলে পারব।
না, মুখের কথায় মুহূর্তের মধ্যে শিখিয়ে দিলে পারবেন না। নিজের অস্ত্রে নিজেরাই মারা পড়বেন। জানা থাকলে দুটি গ্রেনেডও দুজনের হাতে দিতাম। এখন কথা নয়, চলুন।
বললেন মোজাফফর।
আমরা তার কথামতো তার পেছন চলতে শুরু করলাম। তখন অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। চতুর্দিকে ঝিঁঝি পোকার শব্দ গ্রাম্য পথঘাট মুখর। আমরা যাদের অনুসরণ করে হাঁটছি তাদের নাম জানলেও স্পষ্ট ভাবে মুখ দেখতে পাই নি। এখনও মোজাফফর ও লতিফ আমাদের কাছে দীর্ঘতর ছায়া মাত্র। সন্ধ্যার অন্ধকারে তাদের মুখাবয়ব কেমন তা বোঝা যায় নি। পথে নেমে এরা এমন নিঃশব্দে আঁটছে যে এদের সতর্কতার প্রভাব আমাকে ও নন্দিনীকেও নিশ্চুপ করে দিয়েছে। আমরা শুধু হেঁটে যাচ্ছি। গ্রামের পথ, জমির আইল আর কখনও কখনও কোনো গৃহস্থের উঠোন ডিঙিয়ে এবং পুকুরের পাড় মাড়িয়ে ক্রমাগত সামনের দিকে এগিয়ে চলেছি। কী এক ধরনের উদ্যম যেন আমাদের সামনের দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। নন্দিনী আমার বাঁ হাতটা আঁকড়ে ধরে হাঁটছে। সে চলতে চলতে নিজেই শাড়ির আঁচল শক্ত করে কোমরে পেঁচিয়ে নিয়েছে। তার চলা দেখলে মনে হবে সারারাত হাঁটলেও সে ক্লান্ত হবে না। মাঝে মাঝে আমার ডান হাতটাকে একটু বিশ্রাম দেবার জন্য হ্যান্ড ব্যাগটা আমার হাত থেকে নিঃশব্দে কেড়ে নিয়ে হাঁটছে। আবার নিজের হাতকে বিশ্রাম দেবার জন্য আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছে। সবি চলছে মুখে একটিও শব্দ উচ্চারণ না করেই।
মাঝরাতে আমরা একটা বড় রাস্তায় এসে উঠলাম। রাস্তায় পা দিয়েই মোজাফফর বললেন, এবার আমরা একটু কথা বলে নিতে পারি। আপনি ইচ্ছে করলে একটা সিগ্রেটও খেয়ে নিতে পারেন। এখান থেকে কলোনীটা খুবই কাছে। একটু এগোলেই বাতি চোখে পড়বে।
নন্দিনী বলল, তাহলে ও একটা সিগ্রেট খেয়ে নিক আর আমি একটু পথের উপর বসি। পা দুটো একটু ভারী লাগছে।
মোজাফফর মনে হল একটু লজ্জিত হয়ে হাসলেন।
হ্যাঁ, আপনার কথা এতক্ষণ একটুও বিবেচনার মধ্যেই আনা হয় নি। একটানা বহুদূর হেঁটে এসেছেন। আপনার একটু বিশ্রাম দরকার। আপনি একটু বসে বিশ্রাম নিন। আমরা বরং তিনজন তিনটা সিগ্রেট ধরাই।
বললেন মোজাফফর। আমি তার কথা শেষ হওয়া মাত্র আমার পকেট থেকে প্যাকেট খুলে এদের দুজনকে সিগ্রেট অফার করলাম।
মোজাফফর ও লতিফ একটু সংকোচের সাথে আমার কাছে থেকে সিগ্রেট নিলেন। লতিফ হেসে বললেন, এতক্ষণ পর্যন্ত আপনাকে সিগ্রেট ধরাতে দিই নি বলে খুব শরম লাগছে।
আমি হাসলাম। মোজাফফর বললেন, কাজ শেষ হলে কী এ পথেই ফিরবেন?
নন্দিনী বলল, একথা তো এই মুহূর্তে কিছুই বলতে পারছি না ভাই। আদৌ ফিরব কিনা সেটাই জানি না।
যদি ফেরেন কিংবা ফেরার সুনির্দিষ্ট তারিখ ও সময় দিতে পারেন তবে বলুন আমাদের স্থানীয় কর্মীরা এগিয়ে এসে নিয়ে যাবে।
আমি বললাম, তেমন সুনির্দিষ্ট তারিখ বা সময় আমরা এই মুহূর্তে দিতে পারছি না। যদি ফিরি তবে যাদের কাজে যাচ্ছি তারাই আশা করি ফেরার ব্যবস্থা করবে।
ঠিক আছে। এবার চলুন হাঁটি।
বললেন মোজাফফর।
আমি সিগ্রেট ফেলে উঠে দাঁড়ালাম। নন্দিনী বলল, এবার ব্যাগটা বরং আমাকে দাও আমি নিয়ে কিছুক্ষণ হাঁটি। কলোনীর গেটে পৌঁছে তোমায় হাওলা করে দেব।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা দর্শনা কাষ্টমস্ কোয়ার্টারগুলোর গেটে এসে উপস্থিত হলাম। মোজাফফর বলল, যদি আপনারা কিছু মনে না করেন তবে এখান থেকেই আমরা বিদায় নেব। আমাদের ওপর ভার ছিল আপনাদের এ পর্যন্তই পৌঁছে দেয়ার। আমার মনে হচ্ছে কলোনীর ভেতর আপনাদের কোনো বিপদ নেই। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবেন, রাত দুটোর গাড়িতে যশোর থেকে এসেছেন। আপনারা যাদের কাছে এসেছেন তাদের নাম বললেই কোয়ার্টার দেখিয়ে দেবে।