আছে। গত রাতে আমাদের পাশের গাঁয়ের হাটে পাকবাহিনী তিনজন চাল বেপারীকে শুধু শুধু গুলী করে মেরে ফেলেছে। আসলে তারা আমাদের মাষ্টার সাহেবের বাড়ির ঠিকানা খুঁজছে। যার বাড়িতে আপনারা এতক্ষণ কাটিয়ে এলেন।
আহমদ আলী সাহেব এ খবর জানেন?
জানেন।
খুব নিচুস্বরে জবাব দিল ছেলেটি।
এ অবস্থায় আমরা নিরাপদে দর্শনায় পৌঁছুতে পারব বলে ভাববো?
জানি না। আমার ওপর হুকুম আপনাদের নিয়ে গিয়ে গাঁয়ের শেষ মাথায় তালগাছের নিচের প্রাইমারী স্কুলের বারান্দায় পৌঁছে দেওয়া। তারা সেখান থেকে আপনাদের নিয়ে যাবে।
আমি বললাম, কুদ্দুস, আজ যখন বিপদের আভাস পাওয়া যাচ্ছে তখন আরও একটা দিন আশেপাশের কোনো আশ্রয়ে অপেক্ষা করে গেলে হয় না?
ছেলেটি হাসল, যেখানে নিয়ে যাচ্ছি সেখানকার গ্রুপ লীডারকে একথা বলবেন। আমাদের এলাকায় তো প্রতিদিনই লড়াই চলছে। পাল্টা মারও লাগান হচ্ছে। যারা আপনাদের নিয়ে যাবে তারা আজ সকালে খালের ভেতর একটা নাওয়ের মাঝে লুকিয়ে থাকা পাঁচজন পাকসেনাকে খতম করেছে। তারা খুব সাহসী দল। ঘাবড়াবেন না।
আর কোনো কথা না বলে আমরা কুদ্দুসের পাশাপাশি চলতে লাগলাম। গাঁয়ের ভেতরের ঘরবাড়িতে মানুষের সাড়াশব্দ পেলাম। একটা ছোটো পুকুরের ঘাটে দেখলাম মেয়েরা বাসন মাজছে। আমাদের দিকে দৃষ্টি পড়ায় কেউ কেউ মাথা তুলে অবাক হয়ে নন্দিনীকে দেখতে লাগল। দুএকটি নেংটা ছোটো ছেলেমেয়ে আমাদের পিছু নিয়েছে দেখে কুদ্দুস তাদের ধমক দিয়ে হাঁকিয়ে দিল।
কুদ্দুসের সাথে আমরা গাঁয়ের পশ্চিম প্রান্তের একটা স্কুলের বারান্দায় এসে উঠলাম। স্কুল বাড়িটা বেশ লম্বা। বারান্দাটায় ইটবাঁধানো। সামনে একটা ফাঁকা জায়গা। সম্ভবত ছাত্রছাত্রীদের এটাই খেলার মাঠ। মাঠের পূর্বপ্রান্তে তালগাছের সারি। কুদ্দুস বারান্দায় উঠেই ইশারায় আমাদের এখানে অপেক্ষা করতে বলে তালবনের দিকে রওনা দিল। সূর্য এর মধ্যেই অনেকখানি নেমে ঢলে পড়েছে। গ্রামের দিকে তাকালে মনে হয় এটা একটা নিষ্প্রাণ লোকালয় মাত্র। গোধূলিবেলা হওয়া সত্ত্বেও কোনো গরুবাছুর চোখে পড়ছে না। শুধু বহুদূরে মধ্যগ্রাম থেকে একটা কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ অস্পষ্ট ভাবে কানে আসছে। আর এদিকে তালগাছের চূড়ায় বেলুনের মতো ঝুলে থাকা বাবুইয়ের বাসাগুলো ঘিরে হল্লা ও তর্কপ্রবণ অসংখ্য পাখির চিৎকারে জায়গাটা মুখর। আমার নিজের গ্রামের কথা অকস্মাৎ মনে পড়ায় আমি নন্দিনীকে বললাম, বাংলাদেশের গ্রাম-লোকালয়ের চেহারা আর জীবনযাপন সর্বত্রই এক।
এমন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যেও এসব খুঁটিয়ে দেখার সময় আছে দেখছি? বাংলাদেশের কবিদের উদাসীনতা ও শহর-গ্রামে একই রকম। মাছের চোখের মতো পলকহীন।
নন্দিনীর কথায় আমি হেসে ফেললাম। চমৎকার উপমা তো! মাছের চোখের মতো পলকহীন। তোমার লেখালেখির অভ্যেস থাকলে মন্দ হত না।
কবি হওয়ার চেয়ে কবিকে দখল করে নেয়ার চেষ্টাটাই এমন কী আর মন্দ। তোমার অবর্তমানে তোমার কাব্যের সমালোচনা আমার দখলদারির জন্য না হয় একটু মন্দ বলবে। কিন্তু আমার সংস্পর্শে তোমার রচনা রসাতলে তলিয়ে গেছে একথা কেউ বলবে না আশাকরি। তুমি কী বল?
ঘাড় কাৎ করে একটা বিদ্রুপাত্মক ভঙ্গিতে হাসল নন্দিনী। আমিও হাসলাম। এতক্ষণে বেলা গ্রামসীমান্তের বৃক্ষসীমার ওপর একদম তেজ হারানো আলোর বলের মতো লুটিয়ে পড়তে চাইছে। একবার তালবনের দিকে তাকালাম। কুদ্দুস আমাদের এখানে অপেক্ষা করতে বলে এদিকে হেঁটে গেছে। নন্দিনী বলল, কুদ্দুস বোধহয় কাউকে ডেকে আনতে গেছে। আমরা এই স্কুলের বারান্দাটায় একটু বসলেও পারি।
আমি বুঝলাম নন্দিনী অনিশ্চয়তার ধুকপুকানিতে কাঁপছে। তার কথায় আমি নিজেই বারান্দায় ধুলোবালি ফুঁ দিয়ে সরিয়ে বসে পড়লাম। হ্যান্ড ব্যাগটার ওপর কনুই রেখে বললাম, বস।
নন্দিনীও বসল। ততক্ষণে বেলা পশ্চিমের মাঠের প্রান্তসীমার গাছের ছায়ার ভেতর অকস্মাৎ ডুবে গেল। যদিও পরিপূর্ণ অন্ধকারে এখনও নেমে আসে নি। তবুও ছায়ায় একটা আবরণের মধ্যে স্কুল বাড়িটা ও সামনের ফাঁকা মাঠটা আচ্ছন্ন হয়ে গেল। বাবুই পাখিদের কিচিরমিচির হঠাৎ যেন শান্ত হয়ে গেছে। তালপাতার ঝুলন্ত বাসাগুলোকে মনে হচ্ছে ডাইনীদের শুকনো স্তনের মত। হঠাৎ ঝিরঝিরে ঠান্ডা হাওয়া বইতে শুরু করেছে।
আমি বললাম, কুদ্দুস মনে হয় একটু দেরি করছে।
দেরি আর কই দেখলে, এই মাত্রতো ছেলেটা গেল। তুমি বরং একটা সিগ্রেট খাও টেনশন কেটে যাবে। আমাদের যারা নিয়ে যাবে তাদের দেখা পেলে তো ছেলেটা ফিরবে।
নন্দিনীর কথা শেষ হওয়া মাত্রই বারান্দায় দুটি মানুষের দীর্ঘ ছায়া দেখা গেল। তালবনের দিকে থেকে ছায়াদুটি স্কুলের বারান্দায় এসে উঠল। দুজনের কাঁধেই অস্ত্রের নল উঁচু হয়ে আছে। আমরা চুপ করে বসে থাকলাম। নন্দিনী অন্ধকারে আমার হাত চেপে ধরেছে।
মানুষ দুটি এগিয়ে এসে আমাদের সামনে দাঁড়াল। একজন বলল, সিগ্রেটটা নিভিয়ে ফেলুন।
আমি মুহূর্তের মধ্যে সিগ্রেটটা জুতোর নিচে চেপে ধরলাম। বললাম, কুদ্দুস কোথায়?
কুদ্দুসের আর দরকার হবে না। আপনারা এখন আমাদের সাথে যাবেন। এখান থেকে দর্শনা হল্ট সাড়ে তিন মাইল পথ। পায়ে হেঁটে যেতে হবে।