নন্দিনী বলল, আপনারাও আমাদের সাথে থাকবেন তো?
না সিস্টার, আমাদের ডিউটি এখানে নয়। অন্যত্র আমরা অপারেশনে যাব। সেটা অনেকদূর। আপনাদের জন্য লোকেরা এসে ঠিক জায়গায় নিয়ে যাবে। ভয় পাবেন না। আমরা এখনই রওনা হচ্ছি। আপনাদের যা যা দরকার খাওয়া-থাকা সব এখানে বসেই যথাসময়ে পাবেন। কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করবেন না। অন্য ভাইয়েরা এসে ইঙ্গিত দিলেই বিনা দ্বিধায় তাদের সাথে রওনা হবেন। আচ্ছা আমি আসি।
বলে কমান্ডার নূর আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। আমি তাকে থ্যাঙ্কস্ বলে তার হাতটা চেপে ধরলাম। নূর নিঃশব্দে তার সঙ্গী সাথীদের নিয়ে বেরিয়ে গেলে স্কুল শিক্ষক আহমদ আলী একটি কিশোরীকে নিয়ে আমাদের খড়ের গাদার কাছে এগিয়ে এসে বলল, আপনাদের চা-নাস্তা এখুনি এ মেয়েটি এনে দেবে। এর নাম সালেহা। আপনারা যতক্ষণ থাকবেন সালেহা আপনাদের দেখশোনা করবে। হাতমুখ ধোয়ার দরকার হলে খড়ের ওপরই পানি ঢেলে সেরে নেবেন। এমন কী বাথরুমের কাজও। খবরদার বাইরে উঁকিঝুঁকি মারবেন না। আমি আসি।
আহমদ আলী সালেহাকে নিয়ে চলে গেলে আমি নন্দিনীকে বললাম, আসল মুক্তিযোদ্ধার জীবন বোধহয় আমাদের শুরু হল।
তোমার ভয় লাগছে?
সঠিক বললে বলতে হয় উৎকণ্ঠায় ভুগছি।
আমার কিন্তু একটুও ভয় লাগছে না বরং একটা কিছু করতে পারব ভেবে আনন্দই লাগছে।
বলল নন্দিনী।
এর মধ্যে সালেহা নামক কিশোরীটা এসে গোয়ালের স্বল্প সংখ্যক কয়েকটি গরু বাছুরের দড়ি খুলে বাইরে নিয়ে গেল। গোবর আর গরুর চেনার গন্ধে দম বন্ধ হয়ে এলেও আমরা খড়ের গাদার পাশে বিছানা খড়ের ওপর পরস্পরের দিকে মুখ করে শুয়ে থাকলাম। আমার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে নন্দিনী বলল, বাংলাদেশে আমাদের প্রবেশের এই প্রথম প্রভাত বেলায় আমাকে একটা আদরের চুমু খাও না কবি। নাও ঠোঁট দুটি এগিয়ে দিচ্ছি।
তুমি সত্যি পাগল নন্দিনী। বুঝতে পারছ না আমরা এখানে একটুও নিরাপদ নই। মাষ্টার সাহেবের সতর্ক করে দেয়ার পরও যদি এমন ছেলেমানুষী করো তবে আমাদের কোনো উদ্দেশ্যেই সিদ্ধ হবে না।
আমার কথায় নন্দিনী হঠাৎ শব্দ করে হেসে ফেলল, আমি প্রকৃতপক্ষে কবির উৎকণ্ঠা তাড়াতে চাই। যারা জীবন বাজি ধরে এখানে এসেছে তাদের আবার প্রাণের জন্য এত মায়া?
আমরা একটা মিশনে এসেছি ধরা পড়লে বা মরে গেলে মিশনটি বিফল হবে। তোমার মুখে এখন হাসি তামাশা মানায় না নন্দিনী।
তামাশা নয়, প্রেম।
প্রেমের চেয়ে বড় বিষয় হল ধরা না পড়ে মুক্তিযুদ্ধের সেবা করা। টাকাটা পৌঁছে দিয়ে দেশের ভেতরে একটা কর্তব্য স্থির করা।
বললাম আমি। আমার কথা ফুরোবামাত্র খড়ের গাদার ওপাশ থেকে সালেহা টিনের একটা বড় থালায় চায়ের কাপ, চিতোই পিঠা, ডিম ভাজি ইত্যাদি এনে আমাদের সামনে রাখল। অনুচ্চ কণ্ঠে বলল, আপনারা খান। আমি পানির জগ আর গেলাস এনে দিই।
আমরা কোনোরূপ আওয়াজ না করেই গরম চিতোই পিঠা আর ডিমভাজিতে কামড় লাগালাম। হঠাৎ এমন প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে তা উদ্বেগে থাকার দরুণ বুঝতে পারি নি। নন্দিনী খুশি এবং ব্যঙ্গ মেশানো স্বরে বলে উঠল, এযে দেখছি প্রেমিক পুরুষের চুম্বনের চেয়েও মিষ্টি।
আমি হাসলাম কিন্তু নন্দিনীর বিদ্রুপের কোনো জবাব দিলাম না। নাস্তার পর একটা সিগ্রেট ধরিয়ে নন্দিনীর টাকার হ্যাণ্ডব্যাগটিতে মাথা রেখে খড়বিচালীর ওপর কাৎ হয়ে শুয়ে পড়লাম। শোয়া মাত্র ঘুমে দুচোখ বুজে এল। আমি নিঃশব্দে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমে ডুবে যেতে যেতে আমার সঙ্গিনীর হাসি-মস্করা শুনতে পেলাম। শুনতে শুনতেই স্বপ্নের উপত্যকায় একটি প্রচণ্ড গুলীবর্ষণের চিত্র দেখে মাটিতে শুয়ে পড়লাম। আর ঠিক তখনই আমার বিপরীত দিক থেকে কে একজন প্যান্ট আর পুলওভার পরা নারীযোদ্ধাকে দেখলাম হাতে একটি পিনখোলা হ্যাণ্ডগ্রেনেড হাতের তালুতে মুঠো করে ধরে আমার দিকে সক্রোধে ছুঁড়ে মারল। বোমাটা আমার মাথার কাছে প্রচণ্ড শব্দে বিদীর্ণ হলে আমি চিৎকার করে খড়ের গাদার ওপর ঘুম ভেঙে বসে পড়লাম।
কি ব্যাপার, ঘুমিয়েই দুঃস্বপ্ন দেখলে নাকি?
নন্দিনীর গলা শুনে আমি চমকে তার দিকে চেয়েই বললাম, পানি খাব।
সে জগ থেকে পানি গড়িয়ে আমার মুখে ধরলে আমি পরম তৃষ্ণায় কাঁপতে কাঁপতে গেলাসের সবটুকু পানি ঢকঢক করে খেয়ে ফেললাম।
.
বেলা পাঁচটায় সালেহা একজন তরুণকে নিয়ে গোয়ালে এসে ঢুকল। আমি ও নন্দিনী দুপুরের খাওয়ার পর একটা দীর্ঘ দিবানিদ্ৰা শেষ করে সবে জেগেছি। তরুণটি নন্দিনীর সামনে এসে বলল, আমার নাম কুদ্দুস। আপনাদের নিয়ে যেতে এসেছি। আর দেরি না করে এখনই চলুন।
আমি বললাম, তুমি কী একাই আমাদের নিয়ে যাবে?
আমি নিয়ে যাব না। যারা নিয়ে যাবেন তাদের হাতে ছেড়ে আসব।
নন্দিনী বলল, আমরা যাত্রার জন্য রেডি।
তাহলে আল্লার নাম নিয়ে আমার পেছনে আসুন।
মুহূর্তের মধ্যে নন্দিনী হ্যাণ্ডব্যাগটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে ছেলেটিকে বলল, চলুন।
আমরা গোয়ালটার বাইরে এসে দাঁড়ালাম। বেলা তখন লাল হয়ে পশ্চিম দিকে ঢলে গেছে। নিমতা গাঁটাকে অতিশয় দরিদ্র কৃষকদের একটি ছোটো গাঁ বলে মনে হল। ভোররাতের দিকে আমরা যখন গাঁয়ে প্রবেশ করি তখন আধো-অন্ধকারে কিছুই ঠাহর করতে পারি নি। এখন চারিদিকে গোলপাতা কিংবা ছনের চালার নিচু কুঁড়ের ব্যাপকতা দেখে গ্রামটার দারিদ্র্য আন্দাজ করলাম। আমরা যখন বের হয়ে আসি সালেহাকে দেখলাম ঘরের ভেতরেই থেকে গেল। বাইরে এসে ছেলেটির মুখের দিকে তাকালাম। একেবারেই কচি বয়েস। ষোল-সতেরোর বেশি হবে না। ফর্সা গোলগাল চেহারা। গায়ে একটা সবুজ শার্ট ও খাকি রংয়ের প্যান্ট। পায়ে রবারের সেন্ডেল। আমি তার গা ঘেষে চলতে চলতে বললাম, এ গাঁয়ে হানাদারের হামলার ভয় আছে নাকি?