ঠিকই তো ভেবেছিলেন। এখন হঠাৎ আবার মতো পাল্টাতে যাচ্ছেন কেন? যখন অজ্ঞাত বিপ্লবীদের বোঁচকা পৌঁছে দেয়ার ভার আপনাদের ওপর কেউ চাপায় নি। তা ছাড়া এতে যে বিপদ আছে সেটাও ভাবতে হবে।
আমার কাহিনী শুনে মুহূর্তের মধ্যে তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করল ইমাম। পারুল তো সব শুনে খাওয়া রেখে হা করে ইমামের কথা শুনতে লাগল।
মিতু শুধু ছেলে মানুষের মতো বলে উঠল, বাবা তিন লাখ টাকা ফেরত দেবেন মামা। আমাকেই দিয়ে দিন না।
ফাজলামা করো না মিতু। বড়দের সব কথা শুনতে চাই। খেয়ে চুপচাপ ঘরে যাও।
মিতুকে ধমক দিল পারুল।
ইমাম একবার চোখ তুলে নন্দিনীর দিকে তাকাল, টাকাটা দর্শনায় নিজেরাই নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব বোধহয় আপনার?
প্রস্তাব নয়, প্রতিজ্ঞা।
সেখানে গিয়ে যদি কোনো বিপদে পড়েন?
সে রকম সম্ভাবনা তো আছেই।
আপনার সাহস আছে।
গম্ভীর হয়ে বলল ইমাম।
আমি বললাম, সাহসের কথা নয় ভাই। তার চেয়ে বড় কথা হল গ্লানিবোধ। টাকাটা একদল মুক্তিযোদ্ধার। যারা দেশের ভেতরে লড়ছে। একটা দুর্ঘটনায় আমাদের হাতে এসে পড়েছে। এখন আপনিই বিবেচনা করুন এ টাকা আমরা নিয়ে বসে থাকতে পারি কিনা। এ টাকা আমাকে ও নন্দিনীকে শান্তিতে ঘুমোতে দিচ্ছে না।
বেশ, আমি আপনাদের দর্শনা হল্টে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করব। তবে সেখানে পৌঁছার পর আপনাদের দায়দায়িত্ব আপনারাই বহন করবেন। আমাদের লোকেরা রাতের অন্ধকারে আপনাদের দর্শনার কাষ্টম কলোনীতে পৌঁছে দিয়ে চলে আসবে।
খাওয়া সেরে উঠে দাঁড়াল ইমাম।
নন্দিনী বলল, আপনাকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোটো করব না। আমরা দেশের ভেতরে গিয়ে মুক্তি বাহিনীর সাথে মিশে দেশের জন্য কিছু করতে চাই। প্রাণ বাঁচানোর জন্য এখানে বসে থাকতে চাই না।
খাওয়া সেরে আপনারা বরং আমাদের কামরায় আসুন। বিষয়টা নিয়ে আরও আলোচনা করতে চাই। বিপদ-আপদের ভয় থাকলেও আপনাদের মনোভাবকে আমি সম্মান না করে পারছি না। যাচ্ছেন যখন বুকে সাহস নিয়েই যান। দেশের ভেতর কোটি কোটি মানুষ বিপদ মাথায় নিয়ে বেঁচে আছে না? তারাই আপনাদের আশ্রয় দেবে সাহায্য করবে।
অপ্রত্যাশিত আশ্বাসের কথা শুনিয়ে ইমাম তার কামরার দিকে চলে গেলে পারুল নিঃশব্দে খেতে লাগল।
আমি বললাম, পারুল বোধহয় একটু চিন্তায় পড়ে গেছে।
আপনারা জেনেশুনে বিপদের মধ্যে যাচ্ছেন।
ভয়ের কিছু নেই বোন।
আচ্ছা এমন হয় না যাদের টাকা তাদের হাতে পৌঁছে দিয়ে আপনারা আমাদের ছেলেদের সাথে আবার এখানে ফিরে চলে এলেন।
পারুল সত্যি ভাবনায় পড়ে গেছে।
নন্দিনী বলল, আমরা তো বোন দেশের মধ্যেই থাকতে যাচ্ছি। সেখানে থাকার আর কাজ করার সুযোগ পেলে এখানে কেন ফিরে এসে তোমাদের বোঝা হয়ে থাকব? তোমার হামিদা বৌদিকে তো আটকাতে পার নি। তার জন্যে তোমার ভাবনা হয় না?
সে কথা আর বলবেন না দিদি। ভাবির কথা ভাবলে আমার রাতে দুর্ভাবনায় ঘুম কেটে যায়। গত রাতটাও আমি ভাবির কথা ভেবে বিছানায় জেগে বসেছিলাম। এখন আবার আপনারা যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছেন।
খাওয়া শেষ করে পারুল মিতুকে নিয়ে উঠে গেল।
.
অনেক রাত পর্যন্ত আমরা পারুলদের কামরায় ইমামের সাথে পরামর্শ করে ফিরে এলাম। স্থির হল তিনজন মুক্তিযোদ্ধা থিয়েটার রোডের অফিস বাড়ি থেকে আমাদের সীমান্তের কাছে একটা ক্যাম্পে নিয়ে যাবে। আমরা কয়েকদিন সেখানেই থাকব। দেশের ভেতর থেকেই কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা এসে আমাদের ভেতর নিয়ে যাবে। শর্ত হল আমি ও নন্দিনী কোনো ব্যাপারেই কোনো কৌতূহল প্রদর্শন করতে পারব না। নিজেদের পরিচয় দিতে হবে স্বামী-স্ত্রী বলে এবং গ্রুপ কমাণ্ডারের আদেশ বিনা ওজরে মেনে নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছব। কাষ্টম কলোনীর গেটে পৌঁছার পর এদের আর কোনো দায়দায়িত্ব থাকবে না। ইমাম এক সপ্তাহের মধ্যে আমাদের যাওয়ার আয়োজন। করবে। মোটামুটি এই ভাবে সব ঠিক হলে আমি ও নন্দিনী আমার কামরায় এসে বসলাম। নন্দিনী বলল, আজ একটু শান্তিতে ঘুমোব। আমি এবার উঠি, বেশ রাত হয়েছে।
আমি হেসে বললাম, রাতটা আজ এখানে কাটালেও পার, ভবিষ্যতে যখন স্ত্রীর ভূমিকায় গ্রামেগঞ্জে যেখানে সেখানে রাত কাটাতে হতে পারে।
ব্যাপার কী হঠাৎ এত দয়া?
ভবিষ্যৎ অজানা বলে লোভ জেগে উঠেছে।
হ্যাংলামো করে কত গা ঘেষাঘেষি করলাম। একবার যে ফিরেও তাকাল না তার মনে লোভ? বিশ্বেস হয় না কবি। এবার আমি ঘরে যাই।
নন্দিনী গম্ভীর মুখে উঠে দাঁড়াল। আমি আর কথা না বাড়িয়ে দুয়ার মেলে দিলাম।
.
ইমামের ব্যবস্থামত এক সপ্তাহের পর আমরা সীমান্ত পার হয়ে কুষ্টিয়ায় একটি গ্রামে এসে পৌঁছলাম। এখান থেকে দর্শনা হল্ট মাত্র পাঁচ মাইল। আমরা পাঁচজন সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধার সাথে ভোর রাতের দিকে নিমতা গাঁয়ের এক স্কুল শিক্ষকের বাড়ির গোয়াল ঘরে পূর্ব ব্যবস্থামত আশ্রয় নিলাম। সন্ধ্যার একটু আগে একটা খালের পাড় ধরে পাঁচ মাইল এগিয়ে গিয়ে দর্শনা হল্ট থেকে একটি রিকশা নিয়ে কলোনীতে পৌঁছতে হবে। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নূর মোহাম্মদ গোয়ালের খড় বিছানো একটা গাদার কাছে আমাকে ও নন্দিনীকে বসিয়ে দিয়ে এখানেই সারাদিন বিশ্রাম নিতে হবে বলে জানাল।
দিনটা আপনাদের দুজনকে এখানে থাকতে হবে। এখান থেকে মুহূর্তের জন্যও বেরুনো চলবে না।