সেটাই বরং ভালো হবে। আমি সব কথা তোমার মতো গুছিয়ে বলতেও পারব না।
তবে যাওয়ার ব্যাপারে তোমারও খানিকটা দৃঢ়তা দেখাতে হবে। নইলে তোমার বোন তোমাকে জেনেশুনে বিপদের ভিতর যেতে দেব কেন?
অর্থবহ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল নন্দিনী।
আমি বললাম, পারুল তোমাকেও যেতে দিতে সম্মত হয় কিনা সেটাই আগে দেখো।
হাসল নন্দিনী। বালিশের ওপর নখ খুটতে খুটতে বলল, তুমি হলে ভাই। যাকে তারা দেশ থেকে ডেকে নিয়ে এসেছেন বিপদ আপদ থেকে দূরে রাখার জন্য। আর আমি কে? আমি হলাম একটা বাড়তি বোঝা। যার আগমনে এই পরিবার, তোমার নিজের সংসারেই সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। পারুল নির্বোধ মেয়ে নন। সবই তিনি বুঝতে পারছেন।
আমি একথার কোনো জবাব না দিয়ে চুপ করেই থাকলাম। নন্দিনীর ধারণাটা অবাস্তব নয়। পারুল স্বভাবতই তার আচরণে এ ধরনের পক্ষপাত এতদিন গোপন রাখে নি। শুধু ইমামের নির্লিপ্ততার জন্যেই সে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছে না।
.
রাতে খাওয়ার টেবিলে ইমামের ডান পাশের চেয়ারে নন্দিনী গিয়ে বসল। বাঁ পাশে পারুল। উল্টো দিকে বসলাম আমি আর মিতু। সাধারণত প্রায় প্রত্যেক দিনই নন্দিনী, আমি আর মিতু একদিকে বসি। আজ ইমামের সাথে কথা বলতে হবে বলেই নন্দিনী ইমামের ডানদিকে বসেছে। পারুল আবার সামান্যতম অস্বস্তিবোধ করে এ জন্যই সম্ভবত নন্দিনী আসন গ্রহণ করেই আগেভাগে বলতে শুরু করল, ইমাম সাহেবের সাথে আমার কিছু কথা আছে বলেই একটু কাছাকাছি বসলাম। আশা করি মিসেস ইমাম কিছু মনে করবেন না।
পারুল প্রথমে একটু হতভম্ব। পরে হেসে বলল, কী আশ্চর্য! আমি কিছু মনে করব কেন? আপনার কিছু বলার থাকলে বলুন না। গোপনীয় বিষয় হলে বলুন আমি বরং কিছুক্ষণের জন্য উঠে যাই!
না আমার কথাগুলো আপনাকেও শুনতে হবে। উঠে গেলে চলবে না।
গলায় একটু গুরুগম্ভীর ভাব আনার চেষ্টা করছে নন্দিনী।
আমি কারো দিকে না তাকিয়ে প্লেটে ভাত তরকারি তুলে নিতে লাগলাম।
নন্দিনীর ভাবসাব দেখে ইমাম একটু অবাক হলেও মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে অপ্রত্যাশিত কিছু শোনার জন্য যেন তৈরি করে নিল। হেসে মুখ ফিরিয়ে বলল, বিষয়টা কী খুবই সিরিয়াস মিস নন্দিনী?
ইমামের প্রশ্ন এবার নন্দিনীর কপট গাম্ভীর্যের দেয়াল তার উচ্চকিত খিল খিল হাসিতে ভেঙে ছড়িয়ে গেল। সকলেই, এমন কী আমিও অকারণে হাসতে লাগলাম।
হাসি থামিয়ে নন্দিনী বলল, ইমাম ভাই, আমার আর কবির ওপর একটা গুরুতর দায়িত্ব বর্তেছে। মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করার দায়িত্ব। আপনার আর পারুলের অনুমতি ও সহায়তা পেলে আমরাও এই লড়াইয়ে কিছু করতে পারি।
পারুল আর ইমাম মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে আমার দিকে দেখল। আমি আর দ্বিধা না করে বললাম, আমরা একটা খুব জরুরি মিশনে দেশের মাটিতে ফিরতে চাই।
ইমাম কিছু আঁচ করার আগেই পারুল ত্রস্ত হয়ে বলল, বলেন কী ভাই? এই যুদ্ধের মধ্যে ঢাকায় ফিরতে চান?
আমি বললাম, না বোন আমার বিজয়ী না হয়ে কী করে ঢাকায় যাব? আমরা বরং বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে একটা শহরে যাব।
সীমান্তের কোনো শহরই এখন নিরাপদ নয়। তবে আপনারা কোথায় যেতে চান জানলে অবশ্য আপনাদের যাওয়া উচিত হবে কিনা সেটা বলতে পারব।
কৌতূহলী চোখ তুলে নন্দিনীর দিকে তাকাল ইমাম।
নন্দিনী বলল, আমরা দর্শনা কাষ্টম কলোনীতে যেতে চাই। সেখানে একটা মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপকে কিছু অর্থ পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব পড়েছে আমার আর কবির ওপর। আমরা স্থির করেছি আমরা সেখানে যাবই। রাস্তাঘাট আমাদের অচেনা বলে আপনার সাহায্য চাই। ওদিকে যেসব মুক্তিযোদ্ধা আসা-যাওয়া করছেন আপনি কী তাদের কোনো দলের সাথে আমাদের পাঠাবার ব্যবস্থা করতে পারবেন না?
খুব পারি। তার আগে জানা দরকার আপনার ও কবি ভাইয়ের ওপর টাকা-পয়সা পৌঁছে দেয়ার দায়িত্বটা দিল কে?
ভাতের প্লেটে লোকমা বাঁধতে বাঁধতে জবাব দিল ইমাম। বেশ একটু উদ্বেগ নিয়ে আমার দিকেও তাকাল। নন্দিনী কিছু বলার আগেই আমি বললাম, ভাই আমরা আপনার কাছে কিছুই লুকোতে চাই না। এ দায়িত্ব কেউ আমাদের ওপর চাপায় নি। দৈবভাবে এ দায়িত্ব আমাদের ওপর এসে এসে পড়েছে। আমরা গৌহাটি থেকে কলকাতার প্লেনে ওঠার আগে ওয়েটিং রুমে এক ভদ্রলোক অনেক মাল-সামান নিয়ে নন্দিনীর পাশের সীটের এসে বসে। প্লেনে ওঠার ডাক পড়লে একটা হ্যান্ড ব্যাগ একটু কষ্ট স্বীকার করে প্লেন পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার জন্য ভদ্রলোক নন্দিনীকে মিনতি করতে থাকলে ভদ্রতার খাতিরে নন্দিনী ব্যাগটা নিয়ে প্লেনে উঠে যায়। কিন্তু সিকিউরিটি গার্ডরা ভদ্রলোককে সিঁড়ির কাছে আটকায় এবং টানতে টানতে তাকে টার্মিনালের দিকে নিয়ে যায়। আমি ও নন্দিনী ব্যাপার দেখে হতভম্ব হয়ে থাকি। হোটেলে এসে ব্যাগটা খুলে আমরা এতে তিন লাখ টাকা, একটা গোপনীয় চিঠি ও কিছু কাগজপত্র পাই। চিঠি থেকে জানতে পারি এই টাকা মিঃ আলী নামক এক ভদ্রলোককে অস্ত্র ও সরঞ্জাম কেনার জন্য পাঠানো হচ্ছিল। হ্যান্ডব্যাগটা দর্শনা কাষ্টম কলোনীর বি-৩ নং হাউসের নাসরিন নামক দশম শ্রেণীর একটি ছাত্রীকে পৌঁছে দিতে বলা হয়েছে। এই হল কাহিনী। ঘটনাটা আগেই আপনাকে এবং আমার বোনকে আমার জানান উচিত ছিল। জানাতে পারি নি কারণ টাকাটার প্রতি আমার ও নন্দিনীর লোভ জেগে উঠেছিল। আমরা ভেবেছিলাম এই টাকায় আমি ও নন্দিনী যুদ্ধের সময়টা কলকাতায় সুখে কাটাতে পারব।