আমার কথা আমি তোমাকে খোলাখুলি বললাম কবি। এখন সিদ্ধান্ত গ্রহণের অর্ধেকটা অধিকার তোমার। টাকাটা ফেরত দিই বা না দিই। আমাদের ভাগ্য আমাদেরকে এক জায়গায় বহুদিন পর্যন্ত বেঁধে রাখার অবস্থায় এনে ফেলেছে। বরং আজ রাতটা তুমি চিন্তা করে দেখো। তবে যাই করতে হয় একটু তাড়াতাড়ি করতে হবে। সময় ও সুযোগ আমাদের জন্য অনন্তকাল দুয়ার মেলে রাখবে না।
নন্দিনীর কথার প্রতিটি শব্দই যেন পাথরের খণ্ডের মতো আমার লোভ ও অকর্মণ্যতার ওপর বৃষ্টি বর্ষিয়ে দিল।
০৭. অনেক চিন্তা-ভাবনার পর
দুদিন অনেক চিন্তা-ভাবনার পর আমি ও নন্দিনী স্থির করলাম টাকাটা আমরা প্রকৃত মালিক অর্থাৎ চুয়াডাঙ্গার ঠিকানায় পৌঁছে দেব। ব্যাগের ভেতর টাকার প্যাকেট এবং কাগজ পত্রের সাথে কাষ্টম কলোনীর যে মেয়েটির কথা চিঠিতে লেখা আছে সেখানে। যেভাবেই হোক ব্যাগটা পৌঁছে দিলে বিপ্লবীরা তাদের যুদ্ধকালীন কৃচ্ছতায় খানিকটা সচ্ছলতা অনুভব করবেন। তারা হয়তো ব্যাগটা খোয়া যাওয়াতে দারুণ অসুবিধায় আছেন। তাছাড়া গৌহাটি বিমানবন্দরে যে ভদ্রলোক ব্যাগটা আমাদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে ভারতীয় নিরাপত্তা রক্ষীদের হাতে গ্রেপ্তার হলেন তার অবস্থাটাও আমাদের ভেবে দেখতে হবে। তিনি যদি ছাড়া না পেয়ে থাকেন তবে তার গ্রেপ্তারের খবরটাও তার সঙ্গীসাথীদের পৌঁছানোর নৈতিক একটা দায়িত্ব আমাদের ওপরই বর্তেছে।
টাকাটা ফেরত দেওয়ার প্রস্তাবে আমি প্রথম সম্মত হতে দ্বিধা করলেও নন্দিনীর নির্লোভ চেহারা ও বার বার মিনতিতে আমি রাজি হয়ে গেলাম। তাছাড়া হঠাৎ পথে দৈবভাবে পাওয়া এই বিপুল অর্থে আমাদের যে বৈধ কোনো অধিকার নেই এই অনুশোচনাও আমাদের উভয়েরই মনে সম্ভবত অতিশয় গোপন ছাইচাপা আগুনের মতো জ্বলছিল। আর হামিদার হোটেলে আগমন এবং সব কিছু জেনেশুনেও ব্যক্তিগত সমস্ত স্বার্থ, সামাজিকতা, স্বামী ও পারিবারিক আশা আকাঙ্খা পরিত্যাগ করে দেশের জন্য আত্মত্যাগের প্রতিজ্ঞায় নন্দিনীর মনে পরাজিতের বেদনা সৃষ্টি হওয়াও অস্বাভাবিক নয়। এই যুদ্ধে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত সে। তার বোন হানাদার বাহিনীর গুলী বর্ষণে পথে প্রাণ হারিয়েছে। তারও নারীত্ব লুষ্ঠিত হয়েছে হানাদারদেরই সহযোগিদের হাতে। তার পক্ষে আকস্মিক স্বাচ্ছন্দ্য, কারো প্রেমময় সঙ্গ কিংবা পথে পাওয়া টাকায় নিরাপদ আশ্রয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকা যে অসম্ভব তা আমি উপলব্ধি করেই টাকাটা ফেরত দেয়ার উদ্যোগে রাজি হয়ে গেলাম।
একদিন দুপুরের খাওয়ার পর নন্দিনী আমার ঘরে এসে দুয়ার ভেজিয়ে দিয়ে আমার বিছানায় এসে বসল।
আমি বললাম, আমাকে কিছু বলবে?
আমাদের বোধহয় আর দেরি না করে স্যুটকেসটা চুয়াডাঙ্গায় পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা উচিত।
গম্ভীর হয়ে বলল নন্দিনী।
আমি বললাম, আমার মনে হয় আমাদের নিজেদের চেষ্টায় কোনো কিছু সাব্যস্ত করার আগেই ইমামকে সবকিছু খুলে বললে কী করা যায় এর পরামর্শ চাইলে ভালো হয়।
এতে যদি ইমাম সাহেব ও পারুল রাজি না হয়? এখন তো যুদ্ধ। এ বিপদের সময় এরা যদি আমাদের এত টাকাকড়ি নিয়ে দেশের ভেতরে যেতে বারণ করেন?
ঘটানাটা ফাঁস করার ব্যাপারে নন্দিনীকে বেশ উদ্বিগ্ন মনে হল।
আমি বললাম, এরা কেন রাজি হবেন না? টাকাটা যেহেতু দেশের ভেতরকার একটা মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপের। নীতিগতভাবে ইমাম এতে রাজি হবেনই। তবে তিনি এ প্রস্তাব দিতে পারেন টাকাটা আমাদের বদলে এখান থেকে অপারেশনে যারা নিত্য যাওয়া আসা করছেন তাদের হাতে পৌঁছে দেওয়ার।
আমি এতে রাজি হতে পারি না।
দৃঢ়তার সাথে অস্বীকৃতি জানাল নন্দিনী।
আমি বললাম, কেন?
এতে ঐসব মুক্তিযোদ্ধাদের রাজনৈতিক গোপনীয়তা ক্ষুণ্ণ হবে। আমরা যদি টাকাটা ফেরত না দিই এরা কোনোদিন আমাদের জিজ্ঞাসা করার জন্য খুঁজে বেড়াবে না। তারা আমাদের চেনে না। নাম ঠিকানাও তাদের অজানা। আমরা যদি অন্যের হাতে টাকাটা পাঠিয়ে এদের গোপনীয় অবস্থানকে অন্যের কাছে উন্মুক্ত করে দিই তবে এদের উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি হবে। আমি তা করতে পারব না কবি। টাকা কেবল তুমি আর আমিই পৌঁছে দেব। পৌঁছে দিয়ে আমরা ক্ষমা চেয়ে এদের আশ্রয় প্রার্থনা করে মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সামিল করে নিতে বলব। আমার ধারণা এরা আমাদের অবিশ্বাস করবে না।
নন্দিনীর কথায় আমি একটু চমকে গেলাম।
তোমার প্রস্তাবটা মন্দ নয়। তোমার বেশ রাজনৈতিক দূরদর্শিতা আছে নন্দিনী। আমি তো অত কথা ভাবতেও পারি নি। বিষয়টা মন্দ নয়। কিন্তু ইমামদের কিছুই না জানানো কী ঠিক হবে? আমরা বাংলাদেশের ভেতরে যেতে চাইলে ইমামের সহায়তা ছাড়া সেটা কীভাবে সম্ভব?
বললাম আমি।
নন্দিনী বলল, ইমাম ও পারুলকে সব কথা জানিয়েই আমরা যাব। তবে কারো হাতে টাকা ও গন্তব্যের ঠিকানা না দিয়ে ইমাম সাহেবের সহায়তায় অপারেশনে যাওয়া কোনো মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপই তো আমাদের বাংলাদেশের ভেতরে পৌঁছে দিতে পারে। চাইকি তারা আমাদের দর্শনা কাষ্টম কলোনীতেও ছেড়ে আসতে পারে। পারে না কি?
আমি হাসলাম।
নন্দিনী বলল, তাহলে আজ রাতেই এদের কাছে টাকা পাওয়ার ইতিহাস এবং আমাদের যাওয়ার প্রস্তাবটা তুলতে হবে।
কে তুলবে?
তোমার দ্বিধা থাকলে আমিই তুলব।