নন্দিনীরা কোনো জবাব দিতে পারল না। একটা হতভম্ব ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আমাদের ঘিরে নারীশিশু ও বৃদ্ধ-বৃদ্ধসহ পুরো দলটা। রাইফেলধারী লোকগুলো আমাদের থেকে চারপাঁচ হাত দূরে। অন্ধকারে অস্পষ্ট হলেও বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না যে এরা আমাদের দিকে রাইফেল তাক করে আছে। যে লোকটা একটু আগে আমাদের গুলী করার ভয় দেখাচ্ছিল সে একটা সিগ্রেট রাতে দেশলাই জ্বালালে আমি তার মুখটা এক ঝলক দেখতে পেলাম। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। গায়ের রং ফর্সাই মনে হল। বয়েসও আমার মতই ত্রিশ-পঁয়ত্রিশের বেশি হবে না। সিগ্রেট ধরিয়েই সে আমার দিকে এগিয়ে এল, বৌয়ের সাথে ফিসফিস করে কি বলছিলে? কোন্ গায়ে তোমার আত্মীয় আছে?
খাটিঙ্গা আবু সর্দারের বাড়ি। নাসির মাষ্টার আমার চাচাতো ভাই।
মুহূর্তে আমি সুযোগের সদ্ব্যবহার করলাম। লোকটা টর্চ আমার মুখের ওপর ফেলল। তারপর আস্তে আস্তে আলোর গোলটাকে নামিয়ে আনল পায়ের ওপর। আলোটা এখন আমার নগ্ন পায়ের পাতায় স্থির হয়ে আছে। নৌকা থেকে পানিতে নামার সময় জুতো খুলে ফেলেছিলাম। পায়ের পাতা দুটি এখনো শুকোয় নি।
তোমরা কোথা থেকে এসেছো?
নারায়ণপুর বাজার থেকে।
সেটা আবার কোথায়?
ভৈরব বাজারের কয়েক মাইল পেছনে। ঢাকা জেলার রায়পুরা থানা এলাকা।
আমি জবাব দিলাম। লোকটা সিগ্রেটে পরপর কয়েকটা সুখটান মেরে বলল, তুমি কোথাকার লোক, কি নাম, কি কর?
আমি বললাম আমার নাম হাদী। বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া। আমি কবিতা-গল্প লিখি। ঢাকায় পাকিস্তান আর্টস কাউন্সিলের লাইব্রেরিয়ান।
সরকারি চাকুরি?
বললাম, হ্যাঁ।
কবি সাহিত্যিক মানুষ সরকারি চাকুরি ফেলে কেন আগরতলা যাচ্চো? মালোয়ানের গোলামি করতে চাও?
আমি চুপ করে রইলাম।
বি. এস. এফ ক্যাম্পের ট্রেনিংয়ে দু’একটা ব্রাস ফায়ার আর হাতবোমা মেরে ভেবেছো পাকিস্তান ভেঙে ফেলবে? পারবে না।
লোকটা সিগ্রেট ফেলে দিল। আবার অস্পষ্ট অন্ধকারে তার মুখ ঢেকে গেল।
পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন করবো আমরা। সর্বহারা পার্টি। সিরাজ শিকদারের নাম শুনেছো?
আমি বললাম, তার নাম সবাই জানে।
ভবিষ্যতে আরও জানবে। তিনিও কবি।
বেশ দৃঢ়তার সাথে কথাগুলো উচ্চারণ করল লোকটা। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। যাক আমরা রাজাকার বা আলবদরের হাতে পড়ি নি। কেন যেন মনে হল এরা আর যাই করুক আমাদের জানে মারবে না কিংবা মেয়েদের বেইজ্জত করবে না। আমি মনে মনে ইন্নু কুনতু মিনাযজলেমিন পড়তে লাগলাম। লোকটা ততক্ষণে তার ক্ষুদ্র সশন্ত্র গ্রুপটির কাছে এগিয়ে গিয়ে কি যেন পরামর্শ করল। তারপর ফিরে এসে বলল, তোমাদের গুলী করে মারাই উচিত ছিল। কিন্তু তুমি খাটিঙ্গার যে বাড়িতে আত্মীয়তার দাবি করলে তারা তোমার আত্মীয় হলেও হারামির বাচ্চা নয়। নাসির আমার বন্ধু। তার ভাই আর বৌয়ের ওপর গুলী চালাতে চাই না। আমাদের সামনে থেকে এক্ষুণি পালাও। আর এক মুহূর্ত দেরি নয়।
লোকটার কথার মধ্যে এমন শ্লেষ ছিল আমরা যেন চাবুক খেয়ে চাঙ্গা হয়ে উঠলাম। কিন্তু আমরা কেউ জানতাম না কোনদিকে যাব। এখনও অন্ধকার কাটে নি। ঝিঁঝি পোকার তীক্ষ্ণ শব্দে রাতের গভীরতা বোঝা যায়। কোনোদিকে পায়ে চলার কোনো পথ ঠাহর করতে পারছি না। আমি বুকে সাহস এনে লোকটাকে বললাম, আমরা তো পথঘাট চিনি না। কোন দিকে যাব অন্ধকারে ঠিক বুঝতে পারছি না। বর্ডারে যাওয়ার পথটা একটু দেখিয়ে দিয়ে গেলে ভালো হয়।
আমার কথায় লোকটা আবার টর্চের আলো ফেলল আমাদের ওপর। আলোটা প্রথম সীমার মুখ থেকে নন্দিনীর মুখে। তারপর সরে এল আমার মুখে।
একটু আগে যে মুক্তিদের ভয় দেখাচ্ছিলে তারা কোথায়?
লোকটা একটু এগিয়ে এল আমার দিকে। আলোটা এখনও আমার মুখের ওপরই আছে। চোখ মেলতে পারছি না।
আমি বললাম, তারাইতো আমাদের নদীর পাড় থেকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা। এখানে থাকার কথা।
আনিসের কথা বলতে গিয়েও বললাম না। কি জানি একজন সশন্ত্র মুক্তিযোদ্ধা আমাদের সাথেই ছিল একথা বলে আবার কোন বিপাকে পড়ি। লোকটা হঠাৎ আলো নিভিয়ে অন্ধকারের মধ্যে বলে উঠল, জাহান্নামে যাও। আমরা তোমাদের হিন্দুস্তানের পথ দেখিয়ে দিতে পারি না।
কথাগুলো বলে তার রাইফেলধারী গ্রুপ নিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। আর তক্ষুণি আকাশে গুড়গুড় শব্দে বিদ্যুতের কয়েকটি চমক হেনে ঝমঝম শব্দে নেমে এল বৃষ্টি। আমরা সকলেই সেখানে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে লাগলাম। এতক্ষণ পরে আমাদের দলের দুএকটা বাচ্চা কেঁদে উঠল। নৌকায় থাকতে আনিসের ভয়ে এতক্ষণ সবাই চুপ মেরে ছিল। পরে ধরা পড়ে যাওয়ার প্রচণ্ড আতংক সকলকেই প্রায় বোবা করে রেখেছিল। এখন সেই নৈশব্দে ফাটল ধরেছে। সীমা আমার হাত ধরে বলল, চলুন আমরা সকলেই হাত ধরাধরি করে সামনের দিকে হাঁটা শুরু করি। দেখা না গেলেও পথ তো একটা আছে?
আমি বললাম, সেটা মন্দ নয়, তবে এতগুলো বুড়ো মানুষ আর বাচ্চাকাচ্চা লাইন বেঁধে ঠিক মতো ঠিক ডিরেকশনে চলতে পারবে তো?
ডিরেকশন আবার কি, আমরা সামনের দিকে সমানে হাঁটতে থাকব। সামনে থাকবেন আপনি। আমরা একে অন্যের কাপড়ের খুঁট ধরে হাঁটতে থাকবো সকাল হওয়া পর্যন্ত কোথাও না কোথাও গিয়ে তো পৌঁছুব?
এ হল নন্দিনীর কথা যদিও তার মুখে দেখা যাচ্ছে না তবুও তার মরিয়া-ভাবটা পাশে থেকে আমি টের পেলাম। তার প্রস্তাব শেষ হওয়া মাত্র আমাদের মধ্যে থেকে এক ব্যক্তি বলে উঠল, সাব আমার ভাড়াটা দিন। আনিস সাবেরে এখন কই পামু। তার সাথে কথা হইছিল জনপ্রতি সত্ত্বর টাকা। বাচ্চা কাচ্চার কোনো পয়সা লাগবে না। ভাড়া পাইলে আমি পোলাডারে লইয়া নাও ভাসাই। আল্লাই জানে আন্দাইর নদীতে আমাগো কপালে কী আছে। হুনলেন তো পাঞ্জাবিরা বোড ভাসাইয়া গুলী চালাইতেছে। আমরা তো আর নাও চালাইয়া ইণ্ডিয়া যাইতে পারুম না।