আমি উঠে দুয়ার খুলে বাইরে এলাম। আমার কামরাটায় এটাচড কোনো বাথরুম না থাকায় আমি ডাইনিং স্পেসের পাশে একটা বাথরুমে এসে নিজেকে সংবরণ করলাম। আমার এখন প্রকৃতপক্ষে টয়লেটের কোনো প্রয়োজনই ছিল না শুধু নন্দিনীর সামনে আবেগে-উত্তেজনায় শেষ পর্যন্ত কেঁদে না ফেলি এ ভয়েই এখানে পালিয়ে এলাম।
মিনিট দশেক পার হলে আমি মুখের উপর ঠান্ডা পানির ঝাপটা লাগিয়ে টয়লেট থেকে বেরিয়ে এলাম। নিজের কামরায় ঢুকে দেখি নন্দিনী বালিশের উপর তার অফুরন্ত চুলের সিক্ত গোছা ছড়িয়ে দিয়ে ময়ুরীর মতো চোখ মুদে শুয়ে আছে। এই মুহূর্তে অপূর্ব রূপসী মনে হল নন্দিনীকে। তার সপ্রতিভ শূন্য গলায় কোনো কণ্ঠহার বা অলংকার না থাকায় গাত্রবর্ণকে সকালের আকাশের মতো স্নিগ্ধ মনে হল।
ঘুমিয়ে পড়লে মনে হচ্ছে?
না।
ঘুমাও না কেন, ঘুমাতে তো চেয়েছিলে?
আমি যথাসমভব গলাটা নিচু রেখে কথা বলতে চাইলাম। একটু আগে এমন উত্তেজিতভাবে হামিদার প্রসঙ্গ উত্থাপন যে ঠিক হয় নি এটা বুঝতে পেরেই যেন আমার গলার আওয়াজ অস্বাভাবিকভাবে খাদে নেমে এল।
নন্দিনী চোখ মুছে বিছানায় শোয়া অবস্থাতেই আমার কথার জবাব দিল।
তুমি কাঁদছিলে?
না তো।
বৌদির জন্য তুমি কাঁদছিলে। কান্না লুকোবার জন্য টয়লেটে পালালে।
আমি কথার জবাব দিলাম না। চুপচাপ বিছানায় নন্দিনীর গা ঘেসে খাটের ওপর বসলাম।
হামিদা বৌদির এভাবে চলে যাওয়াটা তোমাকে খুব দুঃখ দিয়েছে। অনুতাপ ও প্রেম তোমার হৃদয়কে খুবলে খাচ্ছে আমি জানি। আমি এসেছিলাম তোমার পাশে শুয়ে তোমাকে সান্ত্বনা দিতে। খুনসুটি করতে নয়।
নন্দিনী উল্টো দিকে পাশ ফিরলে তার বালিশের একাংশকে খালি হতে দেখে আমি আর কথা না বলে তার পাশে শুয়ে পড়লাম। আমাকে আরও একটু জায়গা ছেড়ে দেবার জন্য নন্দিনী বিছানার আরও ভেতর এগিয়ে গেল। চুল সরিয়ে অন্য বালিশটা মাথার নিচে খুঁজে পাশ ফিরে কথা বলতে লাগল।
হামিদা বৌদি বীরনারী। বাংলাদেশের সাহসের প্রতীক। আমি তাকে হৃদয় থেকেই শ্রদ্ধা জানাই। সাক্ষাৎ হলে একথা অবশ্যই বলতাম। তবে তিনি ধর্ষিতা নন। ধর্ষিতা দেশমাতৃকার প্রতীক আমি। কবি তুমি তো জানো বাঙালি নারীর চরমতম লাঞ্ছনার কালিমা নিয়ে আমি এখনও বেঁচে আছি। কারো জন্যে সত্যি যদি কোনো মহৎ রচনা কবিরা সৃষ্টি করেন তবে আমার চেয়ে বড় উপমা অন্তত তোমার অভিজ্ঞতায় আর কেউ আছে কি? আমার জানা মতে নেই। কোনো শহীদের কথা বলতে গেলে সীমাদির মৃত্যুর যে ছবি তুমি চোখের সামনে দেখলে এর চেয়ে মর্মান্তিক বিষাদমাখা কী কোনো কবি কোনোদিন চাক্ষুস দেখেছে?
সেসব কথা এখন আমাকে কেন মনে করিয়ে দিচ্ছ নন্দিনী?
আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না। অতীত দুঃস্বপ্নের দিন ও রাতগুলো যেন এখন নন্দিনীর কথায় আমার মানসপটে চলচ্চিত্রের মতো ভাসতে লাগল।
তুমি বলছিলে না তুমি কাপুরুষতার মধ্যে ডুবে যাচ্ছ? প্রকৃতপক্ষে প্রেমে কোনো কাপুরুষতা নেই। প্রেম-ভালবাসা অযৌক্তিক আকর্ষণ বলেই কবিরা এতে ডুবে যায়। তুমি আমাকে ভালবাসো বলেই যন্ত্রণা ও অনুতাপের আগুনে দগ্ধ হচ্ছ। হামিদা বৌদিকেও তুমি একদা প্রাণ দিয়ে ভালবাসত, কিন্তু তার বীরমূর্তি ও ভয়াবহ বিহ্বল প্রতিজ্ঞা তোমার মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছে। তুমি, আমি কেউ হামিদা বৌদির মতো সাহসী নই। তবে কাপুরুষও নই। আমরাও দেশের প্রতি আমাদের কিছু কর্তব্য পালন করতে পারি।
কি রকম কর্তব্য?
আমরাও খানিকটা স্বার্থত্যাগ করে দেশের ভেতরে গিয়ে দুর্ভাগা মানুষের আর মুক্তিবাহিনীর সেবা করতে পারি। যুদ্ধে না হয় আনাড়ি বলে এগোতে পারব না। অন্য কাজ তো করতে পারি। পারি না কি?
নন্দিনীর কথায় আমি একটু চমকে গেলাম।
আমরা দেশের ভেতর গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য ও সেবা করতে পারি? সেটা কীভাবে সম্ভব? আমি বিছানা থেকে উঠে বসলাম।
তোমার কথা একটু খুলে বল নন্দিনী, আমরা কীভাবে আবার দেশের ভেতরে ঢুকতে পারি? কীভাবে, কোনো পথে কার কাছে আমরা যাব? কে আমাদের বিশ্বাস করবে?
আমি আবার খানিকটা উত্তেজিত হয়ে পড়লেও নন্দিনী চুপচাপ চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকল। এখন তাকে একটা নিস্তরঙ্গ রহস্যময় সরোবরের মত লাগছে। আমিই আবার কথা বললাম, তোমার পরিকল্পনাটা আমাকে বল নন্দিনী, সাধ্যে কুলালে আমি তা করব।
সত্যি করবে কবি?
এবার সে লাফিয়ে উঠে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগল, আমি জানতাম তুমি রাজি হবে। আমার কথা শুনবে। তুমি তো কবি।
আমি হেসে বললাম, আগে তোমার প্রস্তাবটা শুনি তো?
এই তিন লক্ষ টাকা ও স্যুটকেসের সমস্ত কাগজপত্র আমরা প্রকৃত মালিকদের ফেরত দিয়ে কুষ্টিয়ার চুয়াডাঙ্গায় বিপ্লবীদের সাথে সম্পর্কিত মেয়েটির কাছে যাব। তার হাতে স্যুটকেসটা পৌঁছে দিয়ে আমাদের ভুল ও লোভের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে আমাদের একটু শেলটার দিতে বলব।
গলায় দৃঢ়তা মিশিয়ে কথা বলছে নন্দিনী। তার চোখের ভেতর যেন বাংলাদেশের এক বিশাল ছায়ামেদুর দীঘির টলমলানি।
আমি বললাম, নন্দিনী তুমি আরও ভেবে দেখো। এই টাকার স্যুটকেসটা তুমিই এনেছ। এর ওপর সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার তোমারই, আমি মানি। তবুও বাংলাদেশের এই যুদ্ধ পরিস্থিতিতে আমরা উদ্বাস্তু। এই স্যুটকেসের টাকায় আমরা বাঁচতে পারি। এমনকি সুখীও হতে পারি। এটা হেলায় হারানোর বোকামী না করাই সঙ্গত। একটু ভেবে দ্যাখো।