কথাগুলো বলে হ্যান্ডেল থেকে একটা সাদা তোয়ালে টেনে আমাকে দিয়ে পারুল আবার হাসল, আমি এবার আসি ভাই। আপনাদের জামাই অপেক্ষা করছে।
আমি বললাম, আমার কথা শেষ হয় নি। আর একটু শোন। হামিদাকে তুই আর ইমাম নন্দিনী সম্বন্ধে কী বলেছিস যাতে সে ভাবছে তার ঘর ভেঙে যাচ্ছে?
এমন কথা বলেছে নাকি ভাবি?
হ্যাঁ। সে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে।
আমরা নন্দিনীকে নিয়ে আসা সম্বন্ধে আপনি যা যা বলেছেন এর বেশি কিছু বলি নি। তিনি কিছু না বলে শুনে শুধু গেলেন। যাওয়ার সময় অবশ্য আমাকে হঠাৎ জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেছিলেন। নামার সময় সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ইমামকে বললেন, কবিকে বলবেন মুক্তিযুদ্ধের চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে কিছু কবিতা লিখতে। কলকাতায় বসে থাকলে নাকি আপনার লেখালেখি কিছু হবে না। এসব বলে মিতুকে গেট পর্যন্ত টেনে নিয়ে গিয়ে একাকী গাড়িতে উঠেই ড্রাইভারকে বললেন, চালাও। সম্ভবত গাড়িতে উঠেও ভাবি কাঁদছিলেন। কারণ রুমাল দিয়ে চোখের পানি মুছতে মিতু দেখেছে। রাতে কী আপনাদের ঝগড়া হয়েছিল?
আমি পারুলের প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়ে নিজেরই উদ্গত অশ্রুভরা চোখ দুটি লুকোবার জন্য বেসিনটা ও পারুলকে পেছনে রেখে সোজা নিজের কামরার দিকে হাঁটা দিলাম। এতে পারুল কতটা হতবাক হবে তা একবারও দেখার সাহস আমার হল না।
আমার জন্য নির্দিষ্ট কামরার তালাটা খোলার আগে নন্দিনীর কামরার ভেজানো দরজার দিকে একবার তাকালাম। নন্দিনী হয়ত ভেতর থেকে দুয়ার বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে আছে। নাকি নন্দিনীও হামিদার আগমনের কথা জেনে উপুড় হয়ে কাঁদছে?
নিজেকে খুব শ্রান্ত মনে হল আমার। দুয়ার খুলে ঘরে ঢুকেই বিছানায় লুটিয়ে পড়লাম। হয়ত মুহূর্তেই ঘুমিয়ে পড়তাম। লেপটা যেই পা দিয়ে টেনে তুলে গায়ে দিতে চেষ্টা করছি এমন সময় বাইরে নন্দিনীর আওয়াজ পেলাম।
খোলো। আমি আসব।
আমি উঠে দরজা খুললাম।
পিঠের ওপর ভেজা চুল ছেড়ে দিয়ে নন্দিনী দাঁড়িয়ে আছে। মুখে একটা দুর্বোধ্য। হাসি ছড়িয়ে বলল, ভেতরে যেতে দিতে কোনো আপত্তি নেই তো?
আমি জবাব না দিয়ে দরজার একপাশে দাঁড়িয়ে নন্দিনীকে পথ করে দিলাম। ভেতরে ঢুকে নন্দিনী আমার কামরাটা দেখতে লাগল। টাকার স্যুটকেসটা খাটের নিচে রাখা ছিল। মাথা নুইয়ে সেটা দেখল।
আমি এসে আবার বিছানায় বসলাম।
ইমাম সাহেবের বদৌলতে আমরা বেশ রাজার হালেই থাকব দেখছি।
হেসে বলল নন্দিনী।
আমি কোনো জবাব খুঁজে না পেয়ে চুপ করেই থাকলাম। বুঝলাম আমার ধারণা ঠিক নয়। হামিদার সাথে আমার সাক্ষাতের ব্যাপারটা নন্দিনীর মধ্যে কোনো উদ্বেগই সৃষ্টি করে নি। খুব স্বাভাবিক হাসিখুশি চেহারা। একবার হাত ঘুরিয়ে তার বিপুল ভেজা কেশরাশি পেছন থেকে সামনে বুকের ওপর রেখে আমার সামনে অবলীলায় ঝাড়তে লাগল।
আমি বললাম, বসবে?
তোমার ঘুমটা মাটি করে বসতে মন চাইছে না।
সারাদিন এমন খাটাখাটনি করলে এখন একটু বিশ্রাম নিলে তো পারতে।
বিশ্রাম নিলে তোমার এখানেই একটু শোব।
নন্দিনী খাটের ওপর আমার পাশে এসে বসল।
আমি ভাবলাম হামিদার কথায় রাগ করে তুমি বুঝি পেট ভরে ভাতও খেতে পারলে না।
তার ওপর মিছেমিছি রাগ করতে যাব কেন? তিনি তো আমার কোনো ক্ষতি দূরে থাক একনজর দেখার জন্যও থাকলেন না।
সে থাকলে বুঝি তুমি খুশি হতে?
তা অবশ্য হতাম না। তবে বেদখল জায়গা ছেড়ে দিতাম।
এখন বুঝি আর ছাড়তে মন চাইছে না?
কেন চাইবে, যখন তিনিই হেরে ছেড়ে দিয়ে গেলেন?
হেসে বলল নন্দিনী। হাত দিয়ে আবার কেশরাশি বুকের ওপর থেকে পিঠের দিকে ফিরিয়ে দিতে দিতে শব্দ করে হেসে উঠল, আমি সত্যি আজ পরিশ্রান্ত। তোমার পাশে শুয়ে শুয়ে কিছু কথা বলব। তুমি শোবে না?
মিতু হঠাৎ এ ঘরে এলে কেমন হবে?
কী আর হবে? ভাববে তার নতুন মামি মামার সাথে খুনসুটি করছে। লজ্জা পেয়ে পালিয়ে বাঁচবে।
এবার আমিও হেসে ফেললাম।
তোমার এমন উল্লসিত হওয়ার কারণটা খুঁজে পাচ্ছি না তো। বলবে নাকি
কেন বলব না? আমার বলার মানুষ জগতে তুমি ছাড়া আর কে আছে? তবে তোমার পাশে একটু শুতে দাও, এক্ষুনি বলছি।
আমি বিছানায় উঠে দুটো বালিশের একটি আলাদা করে রাখা মাত্রই আমার শোয়ার তোয়াক্কা না করেই সে শুয়ে পড়ল। মুখে আঁচল চাপা হাসি। আমি কী করব বুঝতে না পেরে বললাম, দরজাটা বন্ধ করে আসি।
দরজায় ছিটকিনি এঁটে ফিরে এলে নন্দিনী উঠে বসল।
এত ভয় পাচ্ছ কাকে? তোমার স্ত্রী তো সব কথা জেনে শুনেই পালিয়েছে।
পালিয়েছে বলো না। বল দেশের প্রতি দায়িত্ববোধই তাকে লড়াই-এর ময়দানে ডেকে নিয়ে গেছে। হামিদার সাথে তোমার আমার কোনো তুলনা চলে না নন্দিনী। হামিদা ধর্ষিতা বাংলাদেশের প্রতীক। হামিদা দেশের মুক্তির জন্য প্রাণ ও ইজ্জত সম্ভ্রমের তোয়াক্কা না করে মৃত্যুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছে। হামিদাই এখন বাংলাদেশ নন্দিনী, হামিদাকে দেখে আমার লজ্জা লাগছে। মনে হচ্ছে এক ধরনের কাপুরুষতার মধ্যে আমি ডুবে যাচ্ছি।
আমার নিজের গলা নিজের কাছেই উত্তেজিত শোনাল। নন্দিনীর দিকে আর তাকাতে পারছিলাম না আমি। মুখ ঘুরিয়ে দরজার দিকে চেয়ে থাকলাম। নন্দিনীও কোনো কথা বলছে না। এভাবে কিছুক্ষণ বসে থাকলে আমি কেঁদে ফেলতে পারি এই ভয়ে আমি তার দিকে না ফিরেই বললাম, তুমি শোও, আমি টয়লেট থেকে আসি।