আমি আন্দাজ করলাম এরা সকলেই হামিদার গতকালের আগমন ও একরাত হোটেলে অবস্থানের বিষয়টি নন্দিনীর কাছে চেপে যেতে চাইছে। হয়তো আমার আত্মীয়দের ধারণা এতে আমার ও নন্দিনীর সম্পর্কটা সন্দেহযুক্ত হবে কিংবা আমি অসন্তুষ্ট হব। এই দুর্ভাগ্যের দিনে ওরা আমাকে হারাতে চাইবে না এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু গতরাতে হামিদার উপস্থিতির কথাটা গোপন রাখা যে অন্যায় এবং আমার বোন, ভাগ্নি ও বোনের স্বামীর কাছে যে আমি সংকুচিত হয়ে যাচ্ছি তা মুহূর্তের মধ্যে আমি বুঝতে পারলাম। তাছাড়া হামিদার গতরাতের পরাজিত চেহারায় যে প্রেম ও উদারতা ছিল তাতে তো একবারও মনে হয় নি নন্দিনী বা আমার প্রতি তার সামান্যতম বিদ্বেষ আছে। মুহূর্তের জন্য গতরাতের হামিদার অশ্রুভরা কথা আমার মনে ভেসে উঠল। আর দেশের মুক্তির জন্য তার ভয়াবহ সিদ্ধান্তের কথাও। আমি নন্দিনীর মুখের দিকে না তাকিয়েই বললাম, তোমাকে একটা সুখবর দিচ্ছি নন্দিনী।
নন্দিনী প্লেট থেকে মুখ তুলল।
আমার স্ত্রীর সাথে গতকাল আমার দেখা হয়েছে।
আশ্চর্য, এতক্ষণ একথা আমায় বল নি কেন? বৌদি কেমন আছেন? কোথায় দেখা হল, থিয়েটার রোডের অফিসে?
উপর্যুপরি একসাথে এতগুলো প্রশ্ন করলেও নন্দিনীর গলা ও চেহারা যে থর থর করে কাঁপছে তা আমি ধরতে পেরে একটা ঢোক গিলে সামনের পানির গ্লাসটা হাতে নিলাম।
আমার অবস্থা বুঝে ইমামই অনেকটা আশ্বাস দেয়ার সূত্রে বলল, আমার সাথে থিয়েটার রোডের অফিসে ভাবির দেখা হলে আমি তাকে হোটেলে নিয়ে এসেছিলাম। ভাবি একরাত আমাদের সাথে ছিলেন। আবার সকালেই তার গ্রুপে ফিরে গেছেন। তিনি ট্রেনিং শেষ করে ফ্রন্টে আছেন। দেশের ভেতরে অপারেশনে যাবেন। এ অবস্থায় একজন মুক্তিযোদ্ধাকে আটকানো যায় না। তাছাড়া আমার দৃষ্টিতে আটকানো পাপও।
ইমামের কথায় নন্দিনীর মধ্যে একটা হতচকিত ভাব। একবার পারুলের দিকে তাকিয়েই আমার দিকে ফিরল। পারুল ও ইমাম মাথা নুইয়ে চুপচাপ খেতে লাগল। আমিও নন্দিনীর চোখের ওপর চোখ রাখার সাহস পাচ্ছিলাম না। আমিও মুখ নিচু করে খাওয়ার ভান করলাম। শুধু মিতুই এই গুমোট অবস্থাটা ভাঙার জন্য দৈবভাবে কথা বলে উঠল, মামানিকে অলিভ রংয়ের ড্রেসে যা সুন্দর লাগছিল না নন্দিনী ফুপু, দারুণ। প্যান্ট, পুলওভারে কী স্মার্ট। আর জানো আম্মা মামানির পকেটে একটা পিস্তল ছিল। একদম গুলিভরা পিস্তল। মামানি আমাকে দেখিয়েছে।
তোমার মামানিকে আরও একটা দিন ধরে রাখলে না কেন মিতু? একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাকে দেখে জীবন সার্থক করতাম।
নন্দিনীর কথায় মিতু ফের বলল, কত সাধলাম, থাকল না যে। মামানি বলে কিনা ফের ঢাকায় দেখা হবে।
মিতুর কাছে বোধহয় বড়দের সব ব্যাপাই একটু খাপছাড়া। কেমন যেন একটু রহস্যময়। সে আমাদের দিকে বড় বড় চোখে কিছুক্ষণ দেখে নিয়ে নিজের খাওয়ার দিকে মন দিল।
.
খাওয়ার পর নন্দিনী হাত ধোয়ার জন্য বেসিনের দিকে উঠে গেল। আমি ভাবলাম সে বোধহয় হাতমুখ ধুয়ে আবার খাবার টেবিলে ফিরে আসবে। ডাইনিং স্পেস থেকে বেসিনটা একটা দেয়ালের আড়ালে থাকায় আমি নন্দিনীকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। কিন্তু নন্দিনী ফিরল না। একে একে আমরা সবাই খাওয়া শেষ করে উঠলাম। ইমাম আগে হাত মুখ ধুয়ে চলে গেলে আমি ও পারুল দুজন দুটা বেসিনে পাশাপাশি দাঁড়ালাম। পারুল সোপ কেস থেকে সাবান তুলে নিয়ে হাতে মাখাতে মাখাতে হাসল।
দিদির বোধহয় আজ ঠিকমত খাওয়া হল না।
হামিদা এসেছিল, একথা তো আর মিথ্যে নয়। তাছাড়া আমি একথা গোপন করতে যাব কেন? গোপন রাখলেও নন্দিনী একদিন জানতই। তখন তোদের প্রতি একটা সন্দেহ সৃষ্টি হত।
আমরা অবশ্যি বলতে যেতাম না।
কেন তোরা এরকম করতি?
ইমাম চায় না প্রবাসে আপনার মনে কোনো অশান্তি সৃষ্টি হোক। তার ধারণা কবিরা সাধারণ সামাজিকতা মেনে চললে কবিতা লিখতে পারেন না। সমাজে কবি সাহিত্যিকদের সাত খুন মাফ।
বলতে বলতে পারুল একটু রহস্যময় হাসি হাসল। যেন তার শ্রদ্ধেয় ভাইয়ের অবৈধ কার্যকলাপের অযাচিত সমর্থন নিজের স্বামীর মুখ থেকে পেয়ে সে খানিকটা দায়মুক্ত।
আমি বললাম, তোর কাছে নিশ্চয়ই নন্দিনীকে এভাবে নিয়ে আসা এবং তার সাথে আমার এভাবে মেলামেশাটা একটা পাপ?
ভাইয়া আমি আপনার খুব নিকট আত্মীয়া হলেও অন্যের বৌ। এদের পারিবারিক মর্যাদার কথা ও শিক্ষাদীক্ষার কথা তো আপনি জানেন। আমি খুব ভয় আর অস্বস্তির মধ্যেই ছিলাম। আপনাদের জামাই আমাকে আশ্বস্ত না করলে আমি হয়ত আপনাকে আমাদের সাহচর্য ছেড়ে যেতেই বলতাম।
মাথা নিচু করে জবাব দিল পারুল। সাবানটা আমার দিকে এগিয়ে দিল।
ইমাম তোকে সত্যি যা বলেছে আমাকে খুলে বলবি?
আমার কৌতূহল দেখে পারুল আবার হাসল, ইমাম বলেছে আপনি যে পরিস্থিতি ও বিপদকে তুচ্ছ করে আমাদের কাছে এসেছিলেন সেটা স্বাভাবিক সামাজিক ন্যায় অন্যায় বিচারের সময় নয়। এটা যুদ্ধ পরিস্থিতি। নন্দিনী দিদিদের দুঃখে আপনি সত্যিকার কবির আচরণই করেছেন, একথা ইমামই আমাকে বুঝিয়ে অস্বস্তি দূর করে দিয়েছে। বলেছে এই অবস্থায় পড়লে ইমামও নাকি এই করত। সে বলে, একজন মহিলাকে আপনি নাকি ভয়ে বিপর্যয়ে পাগল হয়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়েছেন।