আমাদের কারো বুঝতে বাকি রইল না যে আমরা কাদের হাতে পড়েছি। আনিস মুখ লুকিয়ে দাঁড়িয়েছিল। হঠাৎ সে পানির নিচ দিয়ে পা বাড়িয়ে আমাকে ইশারা করলো। আমি অন্ধকারের দিকে ফেরা মাত্রই সে তার এস. এল. আরটা কাঁধ থেকে ডান হাতে নিয়ে খুব আস্তে করে নৌকার তলায় ডুব দিল। আনিসের সাহস দেখে আমি হতভম্ব হয়ে নৌকা ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম।
এ সময় টর্চঅলা লোকটা, যার মুখ আমরা কেউ দেখতে পাচ্ছিলাম না, আমার দিকে আলো ফেলে হেঁকে উঠল, এই তোমার পাশের মানুষটা কোথায়? ডুব দিয়ে পালিয়েছে নাকি? আমি ত্বরিৎ সাহসে বলে উঠলাম, না বোধ হয়। সে ভয় পেয়ে বেহুঁশ হয়ে ডুবে গেছে। তাকে দয়া করে পানিতে নেমে তাড়াতাড়ি খুঁজে বার করুন। তা না হলে মরে যাবে।
মরে যাবে না, জাহান্নামে যাবে।
আমার মুখ থেকে টর্চের আলো সরিয়ে লোকটা বিদ্রূপ করে উঠল। ততক্ষণে তার টর্চের আলো এসে পড়েছে নদীর পাড়ে লাফিয়ে পড়া যাত্রীদের ওপর।
খবরদার কেউ নড়বে না।
সব অসহায় নারী পুরুষ তখন ভয়ে স্তন্ধ। লোকটা টর্চের আলো ফেলল সীমার ওপর। সে তখন নৌকা থেকে নেমে মাটিতে দাঁড়িয়েছে। লোকটা অনেকক্ষণ তার ওপর টর্চ জ্বেলে রাখল। নন্দিনী তখনও নৌকায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। আমি একটু আগে অন্ধকারে বুঝতেই পারি নি কে আমার কাঁধ জড়িয়ে ফোঁপাচ্ছিল। এখন আর বুঝতে বাকি রইল না যে নন্দিনীই গুলীর শব্দে ভয় পেয়ে শেষ অবলম্বনের মত আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল।
লোকটা আবার আলো নৌকার ওপর ফেলল। আলোটা নৌকার ওপর পড়া মাত্রই আমি বললাম, এখানে আরও একজন অজ্ঞান হয়ে গেছে।
কিন্তু আমার কথা শেষ হবার সাথে সাথেই নন্দিনী উপুড় হয়ে থাকা অবস্থায় থেকে মাথা তুললে টর্চের আলোর বৃত্তটা নন্দিনীর মুখের ওপর এসে স্থির হল। লোকটা অনেকক্ষণ অসভ্যের মতো আলোটা নন্দিনীর মুখের ওপর স্থির করে রাখায় নন্দিনী আর চোখ ফেলতে পারছিল না। এই অসভ্যতা আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না। হঠাৎ মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, আলোটা সরান। দেখছেন না চোখ মেলতে পারছে না?
টর্চটা নিভে গেল।
সবাই ওপরে উঠে এসো।
লোকটা আদেশ করল। টর্চের অপর্যাপ্ত আলোয় আন্দাজ করলাম এরা সংখ্যায় মাত্র চার-পাঁচজনের বেশি হবে না। সবার হাতেই থ্রি নট থ্রি রাইফেল। প্রত্যেকটা অস্ত্রের মুখই আমাদের দিকে ফেরানো। আমি নৌকার গলুইটা যাতে নদীর পারের মাটিতে ঠেকে সে কারণে নৌকাটি ধাক্কা দিলাম। নন্দিনী যাতে শাড়ি না ভিজিয়ে ডাঙায় নামতে পারে সে জন্যই অবশ্য নৌকাটাকে ঠেলে দিলাম। লোকটা হাত বাড়িয়ে নাওয়ের মাথাটা ধরলো। আর এক লাফে নৌকায় উঠে এসে নন্দিনীর চুলের খোঁপা মুঠো করে ধরে টান দিল, নেমে আয় মাগী, নেমে আয়। বেহুঁশ হওয়ার পরে অনেক মওকা পাবি।
চুলের মুঠো ধরে টেনে লোকটা নন্দিনীকে নৌকা থেকে পাড়ে নামিয়ে আনল।
আমি তখন পানি থেকে ভেজা কাপড় নিয়ে ডাঙার দিকে পা বাড়ালাম। লোকটির অন্যান্য সঙ্গীরা একটুও কথা বলছে না বা আনন্দ প্রকাশ করছে না। এখন অন্তত চার পাঁচটা টর্চ এক সঙ্গে জ্বলে উঠল নৌকা আর ডাঙায় দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীদের ওপর। নারী-শিশু ও বৃদ্ধ মিলিয়ে প্রায় ৩৪টি প্রাণী। সবাই ভয়ে কাঁপছে। এমন কি শিশুরাও বুঝতে পেরেছে আমরা শত্রুর হাতে ধরা পড়ে গেছি। আমাদের আর রেহাই নেই।
আমি ডাঙায় উঠে দাঁড়ানো মাত্রই একজন বন্দুকধারী লোক টর্চের আলো আমার মুখের কাছে এনে বলল, এই মেয়েটা তোমার বোন?
আমি চট করে মিথ্যা কথা বললাম, না, আমার বৌ।
ও।
আমি বললাম, আমরা আগরতলা যাবো। আমাদের কেন আটকেছেন? আমাদের ছেড়ে দিন, তা না হলে আপনাদের বিপদ হবে। কারণ আমাদের নিয়ে যেতে মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা এখানেই থাকার কথা। সম্ভবত তারা আশেপাশেই আছে। আমাদের ছেড়ে দিলে আমরা আপনাদের ক্ষতি করতে দেব না।
কথাগুলো বলে আমি নদীর পানির দিকে তাকালাম। অন্ধকারে কিছু দেখা যায় না। তবে আবছায়ার মত দূরে দূরে কচুরিপানার ঝোপগুলো বোঝা যায়। আমি আনিসের ডুব দিয়ে পালানোর পর কোথায় গিয়ে ভেসে উঠতে পারে তা মনে মনে আন্দাজ করছিলাম। সম্ভবত সে এসব কচুরিপানার ঝোপের মধ্যেই চুপচাপ মাথা জাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিংবা ডাঙায় উঠে পালিয়েছে।
আমার কথায় লোকটা প্রথমে কোনো জবাব দিল না। পরে সামনে এগিয়ে এসে বললো, তোমরা হারামির বাচ্চা। ভারতের দালাল। দেশটাকে হিন্দুদের কাছে বেচে দিতে যাচ্ছো। সবকয়টাকে কুত্তার মত গুলী করে মারবো। যাও, সবগুলো একঠাঁই জমা হয়ে দাঁড়াও।
লোকটা আমার কাঁধে রাইফেলের কুঁদো দিয়ে একটা ধাক্কা মারল। আমি অন্যান্য যাত্রীদের মধ্যে ছিটকে পড়লাম। মাটিতে পড়ে যাচ্ছিলাম। এর মধ্যে হাত বাড়িয়ে কে যেন আমাকে ধরলো। আমি উঠে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলাম, কে?
আমি সীমা।
আমি বললাম, আপনার বোন কোথায়, নন্দিনী? অনুচ্চকণ্ঠে আমার প্রশ্ন শুনে পাশ থেকে নন্দিনী জবাব দিল, এই তো আমি। এরা কি আমাদের গুলী করবে?
আমি কোনো জবাব দিলাম না। কীই বা বলবার আছে? লোকগুলো যে আশপাশ এলাকার মাস্তান ধরনের লোক তা বুঝতে পারলাম। এটা যে মুকুন্দপুর স্টেশনের কাছাকাছি কোনো এলাকা আমি তা আন্দাজ করেছিলাম। কাছেই হয়ত কোথাও বামুটিয়া বাজার। এখন অন্ধকারে কোনো কিছু বুঝতে পারছি না। নন্দিনী ও সীমা আমার গায়ের সাথে গা লাগিয়ে যেন একটু নির্ভরতা নিয়ে দাঁড়াল। আমি ফিসফিস করে নন্দিনী ও সীমাকে বললাম, জায়গাটা আমার চেনা লাগছে। কাছেই খাটিঙ্গা নামের একটা গাঁয়ে আমার জ্ঞাতিকুটুম্বদের বাড়ি। ভাবছি আত্মীয়দের পরিচয় দেব কিনা। এলাকাটা সম্ভবত আমার দাদার মুরীদদের এলাকা।