এই ঘটনার পর আমিও আরও কয়েকটা দিন নারায়ণপুর আমার আশ্রয়দাতাদের বাড়িতে অপেক্ষা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু চট্টগ্রাম থেকে পালিয়ে যাওয়া আমার বোন ও ভগ্নীপতির কাছে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের মারফত আমার অবস্থানের খবর জানিয়ে আগতলায় চিঠি পাঠালে তারা আনিসের মারফত অবিলম্বে আগরতলায় চলে যেতে চিঠি দেয়। সেই চিঠিই আনিস আমাকে পৌঁছে দিয়ে এখন আমাকে এনে নৌকায় তুলেছে।
এসময় মেয়ে দুজন এসে আমার হাত ও কাঁধ জড়িয়ে ধরলো, না, আপনি কেন আমাদের জন্য নেমে যাবেন। আমরা দুটি মাত্র প্রাণী উঠলে আর এতবড় লম্বা নাও ডুবে যাবে না। আমাদের নিতে হবে। অবলা মেয়েমানুষকে আপনারা এখন কোথায় ফেলে যাবেন? অগত্যা আনিসকে রাজি হতে হল। এখন আনিস আমাকে সেই খোটাই দিচ্ছে।
আমি মেয়েটার, আমাকে জড়িয়ে ধরে, এই ফোঁপানি আর সহ্য করতে পারছিলাম না। নৌকায় ওঠা অবধি দুবোনকে সামনে গলুইয়ের কাছে পাটাতনে দুটি ত্রস্ত চড়ুইয়ের মত কাঁপতে দেখছিলাম। কোনো কথা হয় নি। নৌকোর বত্রিশজন যাত্রীর মধ্যে আমি ও আনিস ছাড়া আর সকলেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। সকলের চোখ মুখই ফ্যাকাশে। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কাঠের মতো নিষ্ক্রিয়, অসাড়। এর মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যাই বেশি। একবার আমি ভয়ে নিশ্চল মেয়ে দুটিকে তাদের পরিচয় ও নামধাম জিজ্ঞেস করে বুঝতে পারলাম তাদের সমস্যাও আমার মতোই। তারাও তাদের অভিভাবককে হারিয়ে খুঁজছে। তার নাম অজয় আড়তদার। অনেক টাকা নিয়ে সে ঢাকায় মাল কিনতে গিয়ে আর ফিরে আসে নি। সেও কি ঘটনাচক্রে বা দৈবক্রমে ভারতেই পালিয়েছে? আমি একবার এদের পরিচয় জানতে গিয়ে এদের কার কী নাম তা জিজ্ঞেস করতেই ছোটো বোনটি আগে জবাব দিল, আমি নন্দিনী। আর ইনি আমার বোন সীমা। ভৈরব রেলওয়ে স্কুলের হেড মিসট্রেস। ২৩শে মার্চ আমার জামাই বাবু ঢাকা গিয়ে আর ফেরেন নি। আমরা এখন কোথায় যাবো, কি করব বুঝছি না। আমাদের বাঁচান।
শেষ বাক্যটা এমন মর্মান্তিকভাবে উচ্চারিত হল যে আমি পর্যন্ত ভয় পেলাম। নন্দিনীর চোখ ভয়ে বিস্ফারিত। দেখতে মেয়েটি গৌর বর্ণের হলেও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার জন্য তার দিকে চোখ রাখা যায় না। ছিপছিপে দোহারা গড়ন। পরনে একটি ভারতীয় ছাপা শাড়ি। হলদেটে কালো ব্লাউজ। শাড়ির আঁচলে বাহু দুটি ঢাকা থাকায় স্বাস্থ্যের দীপ্তিটা চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে। তবে নৌকায় বসার ধরন ও নাওয়ের দুলুনিতে অভ্যস্ত থাকার লক্ষণ সহজেই ধরা পড়ে। তার বিশাল বেণী যেন নদীতে একটা সাপ নেমে যাওয়ার কসরৎ করছে।
সীমা দীর্ঘাঙ্গী ও একটু আলুথালু। শাড়ির আঁচল অসাবধানে বুক থেকে সরে যাওয়াতে তার পূর্ণ নারীরূপ আমি একবার দেখে ফেলে চোখ ফিরিয়ে নিলাম। তার বর্ণও গৌর। নাক টিকলো। চোখে শিক্ষিকার অপরিহার্য চশমা। সম্ভবত চোখ তেমন খারাপ নয়। ভ্রূরেখা স্পষ্ট। চুল খোঁপায় শক্ত করে টেনে বাঁধায় দৃষ্টি একটু উদভ্রান্ত হলেও চিবুকের গড়নটা দৃঢ়চেতা মহিলার মতো।
হঠাৎ গুলীর শব্দ খুব কাছে চলে এল বলে মনে হল। প্রচণ্ড শব্দ। এতক্ষণ আমাদের দক্ষিণ পাশ থেকে অর্থাৎ আখাউড়ার দিক থেকে আসছিল। এখন মনে হয় নদীর ভেতর থেকে শব্দটা আসছে। হানাদাররা কী তবে আমাদের বোট নিয়ে তাড়া করছে। এবার সত্যি আমি ভয় পেয়ে গেলাম। আমার পিঠের ওপর সওয়ার হওয়া মেয়েটা ভয়ে চুপ হয়ে গেল। তবে তার ভেতরে আতংকিত অসহায় অবস্থাটা আমি বুঝতে পারছিলাম। তার ফোঁপানি ও কান্নার উথলানো ধকলটা তার ভেতরেই গুমরে মরছিল। আমি একটা ভয়ার্ত দেহের কম্পন আমার ঘাড় ও পিঠের ওপর বহন করছিলাম। কিন্তু অবস্থাটা আমার কাছে অসহনীয় মনে হওয়ায় আমি পিঠের ওপর থেকে তাকে গায়ের জোরে একপাশে নামিয়ে এনে নৌকার পাটাতনে আতে উপুড় করে শুইয়ে দিলাম। আনিসকে উদ্দেশ করে বললাম, এখন উপায়?
আনিস আমার কথার জবাব না দিয়ে নৌকার সকল যাত্রীর দিকে গম্ভীর গলায় বলল, পাঞ্জাবিরা বোট নিয়ে এদিকে আসছে। সাবধানে কেউ একটু টুঁ শব্দ করবেন না। নৌকায় যারা জোয়ান পুরুষ আছেন সকলেই পানিতে নেমে পড়ুন। বুক পানির বেশি হবে না। ঐ নদীর পার এদিকেই হবে বোঝা যাচ্ছে। এই মাঝি, তুমিও নামো। নাও ঠেলে দ্রুত কিনারায় নিয়ে যেতে হবে। মেয়েরা আর বাচ্চারা নৌকায় থাকবে। সাবধান, হুটোপুটি করে সবাইকে ধরিয়ে দেবেন না।
আনিসের কথায় আমি নিঃশব্দে পানিতে নেমে গেলাম। তার আন্দাজ ঠিকই। এখানে বুক পানির মধ্যে পা মাটিতে ঠেকলো। আমরা দ্রুত নৌকাটাকে বাঁদিকে ঠেলে নিয়ে যেতে লাগলাম। চতুর্দিকে মিশমিশে অমাবস্যার অন্ধকার থাকলেও নদীর তীরটা ঠাহর করা যাচ্ছে।
আনিসের ধমকে এবং গুলীর ক্ষণ-বিরতির ফাঁকে নৌকার সমস্ত আরোহীরাই ভয়ে পাথর হয়ে আছে। কারো কোনো সাড়া বা নড়াচড়া নেই। আমি পানির ভেতর দিয়ে সর্বশক্তিতে নৌকাটাকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিলাম। আনিস বলল, সামনেই ঘাট। আমাদের লোকজন থাকার কথা। থাকলে রক্ষা, না থাকলে আন্দাজে চলতে হবে।
অল্পক্ষণের মধ্যে আমরা নৌকা টেনে পাড়ে এনে ভিড়ালাম। না, এখানে কেউ আমাদের জন্য অপেক্ষায় নেই। নাওটা পাড়ে এসে লাগামাত্র সকলেই অন্ধকারে একসাথে তীরের দিকে লাফিয়ে পড়ল। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই নদীর তীরে ঝোপ জঙ্গল থেকে টর্চের আলো এসে পড়ল আমার ও আনিসের মুখের ওপর। একটা লোক টর্চের আলোর ভেতর একটা থ্রি নট থ্রি রাইফেল আমাদের দিকে তাক করে এগিয়ে এল, খবরদার কেউ পালাবার চেষ্টা করবে না। আমরা নৌকাটা সার্চ করবো। কারো কাছে হাতিয়ার থাকলে আমাকে দিয়ে দাও। আমরা কারো ক্ষতি করবো না।