বুঝলাম। কিন্তু একে এ অবস্থায় পথে রেখে আমি তোদের সাথে যেতে পারব না পারুল। আমি নন্দিনীর কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। একে পথে নিঃসঙ্গ ফেলে কোথাও যাবো না।
আমার কথায় পারুল গম্ভীর হয়ে বলল, আমি আপনাদের জামাইয়ের সাথে এ ব্যাপারে আলাপ করব। তবে আমরা যে একটা যুদ্ধের ভেতর আছি, এটাও আপনাকে বিবেচনা করতে হবে।
পারুলের কথার মধ্যে যুক্তি থাকলেও আমার ভালো লাগল না। আমি বললাম, তোদের ওপর কোনো বোঝা চাপাতে আমি চাই না। তেমন পরিস্থিতি হলে তোরা না হয় আমাকে এখানে রেখেই যাবি। জীবনের নিরাপত্তা যখন পেয়েছি তখন আমার জন্য তোদের আর চিন্তা করতে হবে না।
আপনাকে ফেলে যেতে তো আমরা ডেকে আনি নি। এই যুদ্ধের অভিজ্ঞতার কথা আপনি সঠিক ভাবে বাংলাদেশের তরুণদের কাছে উপস্থিত করবেন। এই আশা নিয়েই আপনাদের জামাই আপনাকে লোক মারফত চিঠি দিয়ে পাঠিয়েছে। তাছাড়া দেশের ভেতর আপনার মতো প্রতিভাবান লোকদেরই হানাদাররা হত্যা করছে। আর একটি কথা, ভাই আপনার সম্বন্ধে আমার স্বামীর খুব উচ্চ ধারণা। আমার কথাটা একটু মনে রাখবেন। বলল পারুল।
আমি বললাম, আমি কী একথা জানি না ভেবেছিস?
তাহলে আমার আর কিছু বলার নেই।
পারুল সরে গেলে আমি নন্দিনীর কামরার দুয়ারে ঝোলোনো পর্দাটা সরালাম। আমার ধারণা ছিল নন্দিনী জ্বরের ঘোরে বেহুঁশ হয়ে ঘুমুচ্ছে। কিন্তু আমার আন্দাজ ঠিক নয়। নন্দিনী গলা পর্যন্ত কম্বল টেনে রেখে কড়িকাঠের দিকে পলকহীন তাকিয়ে আছে। আমি আস্তে করে ডাকলাম, নন্দিনী।
চমকে গিয়ে নন্দিনী আমার দিকে মুখে ফেরাল।
আমি নন্দিনী, হাদী। একটু ঘুমানোর চেষ্টা করো। এ বিপদের তোমার শরীরটা ভালো থাকা দরকার।
আমি এগিয়ে গিয়ে খাটের শিথানে নিঃশব্দে বসলাম। হাত বাড়িয়ে তার কপাল ছোঁয়া মাত্রই নন্দিনীর দুচোখের কোণ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল। এখন নন্দিনীর গায়ের তাপমাত্রাটা একটু নমনীয় হয়েছে বলে মনে হল। বললাম, তোমার জ্বর ছেড়ে যাচ্ছে। হঠাৎ ঝমঝমিয়ে পানি ছেড়ে গোসলটা তোমার সহ্য হয় নি। তুমি ঘুমাও আমি বৈঠকখানার সোফায় গিয়ে একটু গা এলিয়ে দিই।
আমার কথার কোনো জবাব দিল না নন্দিনী। কিন্তু উঠতে গেলে আমার হাত টেনে ধরল। আমি আবার বিছানার ওপর চুপচাপ বসে পড়লাম। এ সময় হঠাৎ আমার ভগ্নিপতি ইমাম এসে ঘরে ঢুকেই জিজ্ঞেস করল, ভাই, আপনি নাকি আমাদের সাথে কলকাতা যেতে চাইছেন না? কেন বলুন তো?
আমি বললাম, নন্দিনীকে এ অবস্থায় ফেলে আমি এখন তোমাদের সাথে কীভাবে যাই। আর যাওয়াটাও এখন জরুরি। আমি না হয় কয়েকদিন পর গিয়ে তোমাদের সাথে মিলিত হব।
না, এখানে একবার থেকে গেলে আপনি আর যাবার সুযোগ করতে পারবেন না। এখানে কোথায় থাকবেন, কী করবেন? কষ্টের সীমা থাকবে না আপনাদের। তাছাড়া আমি আপনাকে লোক পাঠিয়ে এনেছি দেশের ভেতরের অনিশ্চিত অবস্থা থেকে বাঁচাতে। আমাদের হাতে আরও তো কয়েকদিন সময় আছে। এর মধ্যে আশা করছি ইনি সুস্থ হয়ে উঠবেন।
নন্দিনীর দিকে এগিয়ে গিয়ে ইমাম তার কপালে হাত রাখল।
আমি আপনাদের বোঝা হয়ে গেলাম। শরীরটা দুর্বল। তবে জ্বরটা ছেড়ে গেলে আমি যেতে পারব।
বলল নন্দিনী।
ইমাম বলল, এর মধ্যে আপনি সেরে উঠবেন। এই তো আপনার জ্বর এখন তেমন নেই। গাটা একটু গরম। আমরা তো আর হেঁটে বা গাড়িতে যাচ্ছি না। যাবো প্লেনে, আগরতলা থেকে গোহাটি হয়ে কলকাতায়। ইমামের কথায় আশ্বস্ত হয়ে নন্দিনী সকৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে একবার ইমাম ও পরে আমার দিকে তাকাল।
০৪. যাবার দিন সকালে
যাবার দিন সকালে ভারতীয় এয়ারফোর্সের সামরিক পরিবহণ বিমানে আমরা আগরতলা থেকে গোহাটি এসে নামলাম। এখান থেকে ইন্ডিয়ান এয়ার লাইনসের বিমানে আমাদের কলকাতা যাওয়ার কথা। আসার সময় গাদাগাদি করে এক রকম দাঁড়িয়েই আমরা এখানে এসে পৌঁছাই। সর্বক্ষণ নন্দিনী আমার কাঁধ ধরে ছিল। তার শারীরিক দুর্বলতা এখনও কাটে নি। তবু মানসিক সাহসেই সে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে।
গোহাটি এয়ারপোর্টে আমরা পারুলদের বাক্স প্যাটরার ওপর বসলাম। বিমান বন্দরে খুব ভিড়। মনে হল সকলেই কলকাতার যাত্রী। আমাদের টিকেট অবশ্য আগরতলা থেকেই ওকে করে দেওয়া ছিল। তবুও ইমাম টিকেট ইত্যাদি নিয়ে কাউন্টারের বিশাল লাইনের মধ্যে দাঁড়াল লাইনের মধ্যে দাঁড়াল। কিন্তু বেশি সময় তাকে কষ্ট করতে হল না। সামরিক পোশাক পরা একজন অফিসার কাউন্টারের ওপাশ থেকে বেরিয়ে এসে ইমামকে কী যেন বলল। ইমাম তার হাতে আমাদের পাঁচজনের টিকেট ও দরকারি কাগজপত্র তুলে দিলে ভদ্রলোক দ্রুত সেসব নিয়ে কাউন্টারের পেছনের কামরায় গিয়ে ঢুকল।
ইমাম ফিরে এলে আমি তাকে ব্যাপার কী জিজ্ঞেস করলাম। ইমাম জানাল, আমি যে যাচ্ছি এ ব্যাপারে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ অবহিত আছেন।
আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
কিছুক্ষণ পরেই সামরিক পোশাক-পরা ভদ্রলোক আমাদের দিকে এগিয়ে এসে বললেন, প্লেন রেডি। আপনারা পেছনে আসুন। মালপত্র টানতে হবে না। ওগুলো আমাদের লোকজন প্লেনে তুলে দেবে। এই নিন আপনাদের টিকেট ও বোর্ডিং কার্ড।
ইমাম টিকেটগুলো নিয়ে পকেটে রাখল। আর বোর্ডিং কার্ডগুলো এক এক করে আমাদের ধরিয়ে দিল।
আমি দেখলাম বোর্ডিং কার্ডের মাঝামাঝি জায়গায় হলুদ রংয়ের এক একটি ক্লিপ স্টেপলার দিয়ে আঁটা। স্লিপের ওপর রবার স্ট্যাম্পের ছাপ এবং ছাপের ওপর কার যেন একটা ইংরেজি স্বাক্ষর। সম্ভবত এটাই আমাদের পরিচিতজ্ঞাপক ছাড়পত্র।