এর মধ্যে খালেদ মোশাররফকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে পারুলের জামাই ঘরে এসে ঢুকল।
হাদী ভাই, আপনি শেষ পর্যন্ত, ঢাকা থেকে ঠিকমতো আমাদের কাছে এসে পৌঁছলেন?
আমি জামাইয়ের কথার জবাবে হেসে বললাম, ঠিকমতো এসে পৌঁছতে পারি নি ভাই, অনেক লোকসান দিয়ে এ পর্যন্ত এসে পৌঁছেছি। আপাতত তোমাদের এখানে নিরাপদ। এখন তো আর চোখের সামনে বিভীষিকা দেখছি না।
এখনও আমরা নিরাপদ নই ভাই, এক পরিচিত দুঃশাসন থেকে অপরিচিত আধিপত্যে এসে আত্মসমর্পণ করেছি মাত্র। নিজেকে খুব নিরাপদ ভাববেন না ভাই। আপনি কবি মানুষ, আবেগ দিয়ে বিচার করতে অভ্যস্ত। আমরা কয়দিনে আবেগ বা স্নেহ মমতার সীমা অতিক্রম করে এসেছি। এখানে চলছে সামরিক প্রশিক্ষণ। প্রতিশোধের মন্ত্র ছাড়া এ লড়াইয়ে জেতার সম্ভাবনা খুবই কম। জাতিগতভাবে ক্রোধকে জাগিয়ে তুলতে হবে। এখানে অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনার সুযোগ নেই।
কথাগুলো বলতে বলতে আমার ভগ্নিপতি ইমাম আমার পাশে এসে বসল। আমি খাটের ওপর পা তুলে আরাম করে বসলাম। পারুল ধুমায়িত চায়ের পেয়ালা নিয়ে হাজির হল। মনে হল নন্দিনী যেন গত কয়েকদিনের সব রকম দুর্ভাগ্যের আঘাতকে মুছে ফেলে স্নান সেরে এসেছে। তার শরীর থেকে সাবানের গন্ধে ঘর ভরে গেছে। নন্দিনীর শরীরের সপ্রতিভ শান্ত শ্রী আমার বোন পারুলেরও দৃষ্টিতে পড়ল।
বাহ, এ টাঙ্গাইলটায় আপনাকে তো দারুণ মানিয়েছে।
আমি বললাম, স্নানের পর তোমাকে খুব ভালো লাগছে নন্দিনী।
আমার কথায় নন্দিনীর চেহারা একটু সলজ্জ হল। আড়াচোখে আমার বোনকে একটু দেখে নিয়ে বলল, আপনার আয়নার কাছে নিয়ে চলুন। চুলে জট বেঁধে গেছে।
আসুন।
আমাকে গোসলখানায় ঢোকার ইঙ্গিত করে পারুল নন্দিনীকে নিয়ে অন্য ঘরে চলে গেল।
খাওয়ার টেবিলে নন্দিনী খুব উসখুস করতে লাগল। পারুল মাছ ও মাংসের বাটিগুলো বারবার নন্দিনীর দিকে এগিয়ে দিলেও নন্দিনী তেমন কিছুই পাতে তুলল না, আমার বোনকে বলল, আমার শরীরটা ম্যাজ ম্যাজ করছে। আমাকে আর সাধবেন না।
আমার রান্না বোধহয় আপনার রুচছে না। মাছ-মাংস না নিন তো ডাল দিয়ে আরও কয়েক লোকমা মুখে তুলুন। আপনি তো কিছুই খেলেন না।
পারুলের কথায় বোধহয় নন্দিনী লজ্জা পেল।
না না। আপনার রান্নার কোনো তুলনা হয় না। আমরাও যতটা পারি মাছ-মাংস আপনাদের মতই রাঁধি। আমার আসলে শরীরটাই ভালো নেই। মনে হচ্ছে শরীরে একটু আগে বেশি পানি ঢালাটা ঠিক হয় নি। একটু জ্বর বোধ হচ্ছে।
নন্দিনীর কথায় পারুল তার মাথায় বাঁ হাত ছুঁইয়ে চমকে উঠে বলল, হায় আল্লাহ, আপনার তো গা পুড়ে যাচ্ছে। থাক আর খাওয়ার দরকার নেই। চলুন আপনাকে একটা আলাদা কামরায় শুইয়ে দিয়ে আসি।
পারুল উঠে দাঁড়াল। বেসিনে গিয়ে হাত ধুয়ে মুখে পানি দিতে দিতে পারুলকে বলল, আমাকে একটু ধরুন।
আমি খাওয়া ছেড়ে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। নন্দিনী যে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না তা মুহূর্তের মধ্যে আঁচ করতে পেরে এগিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলাম।
কি হয়েছে নন্দিনী? তোমার কী খুব খারাপ লাগছে?
পারুল আমার দিকে মুখ তুলে বলল, ভাই এর শরীর খুবই দুর্বল। একে নিয়ে আমার সাথে আসুন।
আমি নন্দিনীকে নিয়ে পারুলের সাথে আস্তে আস্তে চলতে লাগলাম। নন্দিনীর হাঁটতে খুব কষ্ট হচ্ছে দেখে তার সমস্ত ভর আমার নিজের ওপর রেখে তাকে একটা আলাদা কামরায় খাটের ওপর শুইয়ে দিলাম। পারুল একটা হালকা কম্বল এনে নন্দিনীর শরীর ঢেকে দিল। নন্দিনী চোখ মুদে আছে দেখে আমি পারুলকে বললাম, চল আমরা তোর ঘরে গিয়ে বসি। ও একটু ঘুমিয়ে নিক। জাগলে পরে না হয় একজন ডাক্তারকে ডেকে আনার ব্যবস্থা করা যাবে।
আমার কথায় পারুল নিঃশব্দে উঠে এল। ঘরের দুয়ার ভেজিয়ে দিয়ে আমরা বাইরে এলে পারুল বলল, ভাই আমার ভয় হচ্ছে। ভদ্রমহিলার অবস্থা খুবই খারাপ।
আমি বললাম, তুই তো বোন জানিস না গত দুদিন যাবত এর ওপর দিয়ে কী দুর্ভাগ্যের ঝড় গেছে। চোখের সামনে এর দিদি গুলীবিদ্ধ হয়ে ছটফট করে মরেছে। এ অবস্থায় মানুষ মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে।
ইনি কী হিন্দু?
হ্যাঁ।
আপনি তো বলেছিলেন ইনি আমাদের আত্মীয়?
পারুলের দৃষ্টিতে কৌতূহল। আমি বললাম, হিন্দু বলেই কী আমাদের আত্মীয় হতে পারে না?
আমার কথার কোনো অর্থ বুঝতে না পেরে পারুল সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল।
এখন যখন আপনি নিরাপদ এলাকায় এসে পৌঁছেছেন, এখন আমাদের সকলেরই উচিত ভাবির একটা খোঁজ খবর নেয়া। বেচারী কী বর্ডার ক্রশ করতে পারল না আবার কোনো বিপদ আপদে পড়ল কিছুই তো বুঝতে পারছি না।
আমি আর ভাবতে পারছি না পারুল।
আমার গলা থেকে হাল ছেড়ে দেয়ার মতো কথাগুলো বেরিয়ে পড়ল। পারুল বলল, এই মহিলাকে আপনি কোথায় পেলেন?
রওনা হওয়ার সময় পথে। এরা ভৈরব বাজারের লোক।
একে নিয়ে আপনার বোধহয় একটু মুস্কিল হবে। কারণ আপনাদের জামাইয়ের এ সপ্তাহে আমাদের সকলকে নিয়ে কলকাতায় এ্যাকজাইল গভর্নমেন্টের দপ্তরে যোগ দিতে হবে। কলকাতার আট নম্বর থিয়েটার রোডে বাংলাদেশ সরকারের দপ্তর। বসেছে। সেখান থেকেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ন্ত্রিত হবে। এ অবস্থায় আমরা আপনাকে সেখানেই নিয়ে যেতে চাই। এখন এ মহিলার শারীরিক যে অবস্থা তাতে বোধহয় আগরতলায় এর কোনো আত্মীয়স্বজন থাকলে এখানেই রেখে যেতে হবে। তাছাড়া এই যুদ্ধে সেখানে আপনার মতো লেখকের অনেক কাজ।