পারুল নন্দিনীকে সখীর মতো গলায় জড়িয়ে ধরে ভেতরে নিয়ে গেল। আমি খালেদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললাম, আনিসের দলটা যে মারা পড়েছে তা কী ভাবে জানলেন?
আমরা লোক পাঠিয়েছিলাম। তারা একটু আগে খবর নিয়ে এসেছে। আনিস গুলী খেয়েও অনেকক্ষণ সজ্ঞানে বেঁচেছিল। তার কাছেই আমাদের ইনফরমার পুরো লড়াইটার খবর জেনেছে। ওরা সমানে ভারী মেশিনগানের গুলীতে আনিসের দলকে কাবু করে ফেলে। যেটুকু অবস্টাকল রেখে আনিসরা পাল্টা গুলী চালাচ্ছিল তা হানাদারদের মেশিনগানের সামনে মুহূর্তের মধ্যে উড়ে গিয়ে আনিসদের উদোম করে ফেলে। এ অবস্থায় বাঁচা অসম্ভব। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে আনিসরা হামাগুড়ি ছেড়ে অকস্মাৎ গুলী ছুঁড়তে ছুঁড়তে উঠে দাঁড়ায়। এবং সামনে ব্রাস মেরে দৌড়ে শত্রুদের দিকে মরিয়া হয়ে এগোতে থাকে। এর ফলে আকস্মিক সুইসাইডাল এ্যাটাকের সামনে পড়ে পাঞ্জাবিরা হঠাৎ নিশানা হারিয়ে হতভম্বের মতো দশ বারোজন জায়গা ছেড়ে একটু পিছাতে গিয়ে গুলীবিদ্ধ হয়ে মাটিতে পড়ে গেলে আনিসের গ্রুপ জয়বাংলা ধ্বনি দিয়ে লাফিয়ে ওঠে। ততক্ষণে অবশিষ্ট পাঞ্জাবিরা পজিশন পেয়েই ব্রাস ফায়ারে আমাদের ছেলেদের গুলীবিদ্ধ করে। খুবই মর্মান্তিক। আনিসের উচিত ছিল, শত্রুর হতভম্ভ হওয়ার সুযোগটা পুরোপুরি গ্রহণ করে তার গ্রুপকে মাটিতে শুইয়ে দেওয়া। ক্রলিং পজিশনে থাকলে যুদ্ধটা এভাবে হয়তো শেষ হত না। জিততে না পারলেও নিজেদের এতগুলো প্রাণহানি সম্ভবত এড়ানো যেত।
যুদ্ধের অবস্থাটা ক্যাপ্টেন খালেদ মোশাররফের কথায় আমি যেন স্পষ্ট দেখতে পেলাম। গত রাত, সকাল এবং দুপুরের সমস্ত ঘটনা আমার চোখের সামনে ভাসতে লাগল। সবকিছু ভেদ করে এসে দাঁড়াল সীমাদির গুলীবিদ্ধ কাতর মুখখানি। রক্তের ছিটায় বুক, চিবুক ও কপালটা সিঁদুরের মতো লাল।
দুশ্চিন্তা ও অসহ্য ঘটনাগুলোর পুনরাবর্তনের হাত থেকে রেহাই পেতে গিয়ে আমি খালেদ মোশাররফকে বললাম, আনিসরা তো আর পেশাদার সৈনিক ছিল না। আপনাদের দক্ষতা এরা কোথায় পাবে? হয়ত সামান্য কয়েকদিনের ট্রেনিংই এদের সম্বল ছিল। পুরোপুরি দক্ষতা না থাকায় হেরে গেল।
খালেদ মোশাররফ হাসলেন, কবি সাহেব, সামনা সামনি যুদ্ধটাও কিন্তু কবিতার আকস্মিক শব্দ পেয়ে যাওয়ার মতোই ব্যাপার। আপনারা যখন লেখেন তখন যেমন জানেন না মিলটা কোন শব্দ দিয়ে ঘটবে। তেমনি প্রকৃত সোলজারও জানে না সাডেন কোন কৌশলে শত্রুরা ধরাশায়ী হবে। শুধু গুলী চালানটা ভালো করে শিখতে পারলেই আত্মরক্ষার কৌশলটাও তার খানিকটা জানা যায়। শত্রুর মুখোমুখি হলে কোনো দক্ষতা বা পূর্ব অভিজ্ঞতার চিত্র সৈনিকদের মনে থাকে না। ফায়ারিংয়ের সামনে দাঁড়ালে অদৃষ্টপূর্ব আত্মরক্ষার অভিজ্ঞতা এসে সৈনিককে সাহায্য করে। যেমন আপনারা না হাতড়েই মিলের উপযুক্ত শব্দটা হঠাৎ পেয়ে যান। যাক, আনিসরা বীরের মতো লড়ে প্রাণ দিয়েছে।
আমি অবাক হয়ে বললাম, আপনি তো দেখি সাহিত্যের খোঁজ খবরও রাখেন?
না, আমি সাহিত্যিক বা কবি নই। তবে আপনাদের কারো কারো লেখা মাঝে মধ্যে পড়ি। তাছাড়া আমার আত্মীয়স্বজনদের কেউ কেউ সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতাও করেন। সেই সুবাদে বাংলাদেশের কবিদের কারো কারো সাথে খানিকটা পরিচিতও। যা হোক, আর কথা নয় আপনি ভেতরে গিয়ে গোসল-খাওয়া শেষ করে একটু বিশ্রাম নিন। বেঁচে থাকলে আবার সাক্ষাৎ হবে।
বেঁচে থাকলে মানে?
মানে, আজ রাতেই আবার ভেতরে যাচ্ছি। ফেরার গ্যারান্টি তো নেই। ফিরলে কথা হবে।
খালেদ উঠে দাঁড়িয়ে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। আমি তার হাতটা ধরলাম। মুখের হাসির মতই তার হাতটা উষ্ণ। আমি তার বীরত্বব্যঞ্জক চিবুকের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার ভগ্নিপতি পেছন থেকে বলল, চলুন আপনাকে নিয়ে ভেতরে যাই।
আমি উঠে দাঁড়িয়েও খালেদের হাতটা ধরে থাকলাম। খালেদ হেসে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে আমার ভগ্নিপতিকে সালাম বলে সৈনিককের মতো দীপ্ত পদক্ষেপে ঘরের বাইরে নেমে গেলেন।
আমি ভেতরে গিয়ে দেখি পারুল নন্দিনীকে তার নিজের পাটভাঙা শাড়ি, ব্লাউজ সায়া ইত্যাদি হাতে তুলে দিয়ে গোসলখানায় ঢুকিয়ে দিল। পারুল আমার দিকে ফিরে বলল, ভাই আপনাকে এক কাপ চা এনে দিই?
আমি বললাম, তোমাদের বোধ হয় আর কোনো টয়লেট নেই?
আছে। নোংরা।
তাহলে ততক্ষণে বসে বসে এক কাপ চা-ই খাই।
এক্ষুণি এনে দিচ্ছি। বলে পারুল ভেতরে চলে গেলে নন্দিনী যে গোসলখানায় ঢুকেছিল আমি সেদিকে তাকালাম। ভেতরে অফুরন্ত পানির শব্দ হচ্ছে। বুঝলাম বেশ কিছুকাল পর নন্দিনী পরিতৃপ্তির সাথে সাবান মেখে গোসল করছে। ভয়ানক ক্ষিদেয় আমার পেট জ্বলছিল। এই অসহনীয় ভুখা পেটে পারুলের গরম চায়ের জন্য বসে আছি। পারুল হয়ত আমাদের খাবার ইত্যাদি তাড়াতাড়ি রেঁধে উপস্থিত করার বিলম্বের কথা ভেবেই আমাকে এক কাপ চা দিতে চেয়েছে।
হঠাৎ গোসলখানায় পানির শব্দের সাথে নন্দিনীর ফোঁপানির শব্দ আমার কানে এল। নন্দিনী কাঁদছে। কান্না আর টয়লেটের ঝরণার ঝরঝরানিতে আমি আমার সঙ্গিনীর অসহয়তা, লজ্জা, ক্ষুৎপিপাসায় কাতর শীর্ণ শরীরের ক্লান্তি ও দ্বিধার দুলুনি এবং কিছুকাল আগে আপন সহোদরা বোনের নির্মম হত্যাকান্ডের পৈশাচিক স্মৃতির কথা চিন্তা করলাম। ভাবলাম বেশ কিছুকাল নন্দিনীর মানসিক ক্ষতগুলো থেকে দুঃস্বপ্ন ঝরতে থাকবে। মনে মনে চিন্তা করলাম, এ অবস্থায় আমি সর্বক্ষণ নন্দিনীর সাথে থাকতে পারবো তো?