এখান থেকে বাড়িটার বৈঠকখানার দরজার চল্লিশ গজের মধ্যে। নীল পর্দা, দরজা জানালায়, বাতাসে দুলছে।
নন্দিনীর ফোঁপানিতে আমার বোনের নাম ধরে চীৎকার করে ডাকতে ইচ্ছে হলেও, আমি নন্দিনীকেই বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলাম। বললাম, তোমার অসম্মানের কাহিনী আমরা কেন বলতে যাব নন্দিনী? আমি ছাড়া এ ব্যাপারের আর যারা সাক্ষী ছিল তারা কেউ তোমাকে চেনে না, পরিচয় জানে না। তাছাড়া তারা যে বেঁচে আছে তারই বা প্রমাণ কি? যেখানে হানাদারদের সাথে একটা মুখোমুখি লড়াই হয়েছে তা তো আমরা গুলীর শব্দেই বুঝতে পেরেছিলাম। আমার মনে হয় আনিসের গ্রুপ ফিরতে পারে নি। তবে কাকে লজ্জা? কে এসব ঘটনার সাক্ষী?
তোমার বৌ বা বোন আমাকে দেখলেই বুঝতে পারবে। মেয়েরা বুঝতে পারে। সাক্ষী প্রমাণ লাগবে না।
বুঝুক। আমাদের মুখ থেকে আমরা কিছুই বলব না।
তোমার বোন তো তোমাকে আমার ব্যাপার জিজ্ঞেস করবে। আমি কে, আমাকে কোথায় পেলে ইত্যাদি?
আমার বুকের ভেতর মুখ রেখে প্রকাশ্য দিনের মেঘাচ্ছন্ন দুপুরে নন্দিনী বলল।
আমরা একবারও কেউ দেখে ফেলার ভয়ে ভীত হলাম না। একবার ভাবলাম না বাড়ির জানালা দিয়ে কেউ আমার বোন বা স্ত্রী আমাকে এ অবস্থায় অর্থাৎ এক মহিলাকে বুকের ওপর জড়িয়ে ধরে আঙিনায় দাঁড়িয়ে আছি দেখে ফেলতে পারে।
আমি বলব আমি তোমাকে নারায়ণপুর থেকে নিয়ে এসেছি। তোমার বোনও তোমার সঙ্গে ছিল। পথে শত্রুর গুলীতে প্রাণ হারিয়েছে। তুমি আমার, মানে আমাদের সাথেই থাকবে। এতে যদি আমার স্ত্রী বা আত্মীয়রা বিরুপ কিছু ভাবে তবে তুমি আর আমি পথে বেরিয়ে এসে নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরাই করব।
আমার কথার আর কোনো জবাব দিল না নন্দিনী। সম্ভবত সে গন্তব্যে পৌঁছে ভেঙে পড়েছে। আমাকে ছেড়ে দিয়ে হাঁটার জন্য পা বাড়াল। আমি তার হাত মুঠোয় ধরে রেখে বাড়িটার বৈঠকখানার দরজায় এসে দাঁড়ালাম। পর্দাটা দুলছে। আমি নন্দিনীর গা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে একহাতে পর্দা সরিয়ে ভেতরে তাকাতেই সোফার ওপর বসা আমার ভগ্নিপতির চোখে চোখ পড়ল। তিনি তার পাশে বসা মাথায় সাদা ব্যান্ডেজ বাঁধা একজন লম্বাচওড়া সুপুরুষ ব্যক্তির সাথে ক্লোজ হয়ে কথা বলছিলেন। আমাদের দেখে চীৎকার করে উঠল, আরে ভাইজান কী করে এলেন? আপনাকে আনতে যাদের কাছে চিঠি পাঠিয়েছিলাম তারা তো কেউ ফেরে নি। বর্ডারের কাছে এক লড়াইয়ে সবাই শহীদ হয়ে গেছে। আমরা তো আপনার কথাই আলোচনা করছি। ঐ দলের সাথেই তো আপনার আসার কথা ছিল। আমরা তো ভাবছি আপনিও হয় মারা পড়েছেন কিংবা ধরা পড়ছেন। ইনি ক্যাপ্টেন খালেদ মোশাররফ, পরিচয় ছিল কি?
খালেদ মোশাররফ উঠে এসে আমার সাথে হ্যান্ডশেক করে বললেন, আপনার জন্য আপনার বোন আর বোনজামাই খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। বামুটিয়া স্পটে আমাদের পুরো গ্রুপটাই খতম হয়ে গেছে বলে এক্ষুণি খবর পেয়েছি। তবে পাকিস্তানীদেরও দশ এগারো জন পড়ে গেছে। আমাদের ছেলেগুলো দারুণ সাহসের সাথে লড়েছে।
এদিকে আমার ভগ্নিপতি চেঁচামেচি করে আমার বোনের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে দৌড়ে অন্দরে চলে গেল। আমি নন্দিনীকে টেনে এনে সোফায় বসিয়ে দিলাম। খালেদ মোশাররফ আমার পাশে এসে বসলেন। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা কী আনিসের সাথে ছিলেন?
আমি বললাম, হ্যাঁ।
ঘটনাটা আপনার কাছে পরে জানব। এখন আপনাদের বিশ্রাম দরকার। কয়েকদিন আগের একটা অপারেশনে আমিও মাথায় জখম পেয়েছি। হাঁটলে মাথা ঘোরায়। আপনার আত্মীয়রা আপনার জন্য খুবই চিন্তিত ছিলেন বলে আমি খোঁজ নিতে এসেছি। আপনাদের খুবই সৌভাগ্য যে ক্রস ফায়ারে পড়ে যান নি।
উগ্বেগমুক্ত আনন্দে ক্যাপ্টেন খালেদ মোশাররফ আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। আমিও তার দৃঢ়চেতা হাতের দিকে হাত এগিয়ে বললাম, আমার এই সঙ্গিনীর বোনের গায়ে গুলী লেগেছিল। মুহূর্তে মুত্যু। পথে লাশ রেখে চলে এসেছি।
বলেন কি?
ক্যাপ্টেন চমকে উঠে নন্দিনীর দিকে তাকালেন।
আপনারা কোথাকার?
এরা ভৈরবের।
নন্দিনী কিছু বলার আগেই আমি জবাব দিলাম।
স্যাড। আপনাদের রিপোর্ট পরে শুনবো। এখন আপনাদের খাওয়া আর বিশ্রাম দরকার।
তার কথা ফুরাবার আগেই আমার বোন পাগলের মতো ছুটে এসে আমার হাত ধরে কান্না শুরু করে দিল, আমি তো ভাবছি আমাদের খবরের কারণেই আপনি আসতে গিয়ে পথে মারা পড়েছেন। ভাবির খবর কি?
জানি না। গত এপ্রিলেই ঢাকা ছেড়ে এসেছে। শুনেছি বর্ডার ক্রস করেছে। এখন কোথায় আছে কী করে বলব।
আমার কথা কেড়ে নিয়ে বোন বলল, এখানে এলে তো আমি জানতাম। সম্ভবত তিনি এদিকে আসেন নি। কতজনের জন্য দুশ্চিন্তা করব। আত্মীয়স্বজন কেউ ঢাকায় নেই। অথচ এখানকার সবগুলো ক্যাম্পই তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি। আমাদের কাউকে পাই। নি। ভাবি যদি এপ্রিলে ঢাকা ছেড়ে থাকেন তবে ভয়ের কিছু নেই। নিরাপদেই কোনো দিক দিয়ে বর্ডার ক্রস করেছেন। আমরা খোঁজ নেব। আপনি ভেতরে আসুন একে নিয়ে। ইনি কী আমাদের আত্মীয়?
আমি বললাম হ্যাঁ।
নন্দিনী মাথা নুইয়ে সোফায় বসেছিল। আমার জবাবে মুখ তুলে একবার আমার বোনকে এক নজর দেখে দৃষ্টি মাটির দিকে নামিয়ে রাখল। আমার বোন পারুল এগিয়ে গিয়ে নন্দিনীর হাত টানল, ভেতরে চলুন।
নন্দিনী উঠে দাঁড়াল। আমি বললাম, যাও নন্দিনী। আমি ক্যাপ্টেন খালেদের সাথে একটু কথা বলেই ভেতরে আসছি।