এর মানে হল আমার জন্য তুমি তোমার স্ত্রীর সামনাসামনি হওয়ার চিন্তাটাকেও ভয় পাচ্ছো।
আমি তোমাকে ভালবাসি নন্দিনী।
তাহলে মানো যে আমাদের ভালবাসার আসলে কোনো যুক্তি নেই। আমরা নিজেদের এই মুহূর্তের প্রয়োজনে একটা অসঙ্গত বিষয়কে মেনে নিচ্ছি মাত্র। এই মেনে নেয়া তোমার স্ত্রীর সাথে সাক্ষাতের শর্তে শর্তাধীন। তিনি এলে আমাকে আমার অদৃষ্টের ওপর ছেড়ে দিতে ইতস্তত করবে না এবং মহিলাকে আমার বিষয়ে কোনোদিন কিছু বলবে না।
আমি এ ব্যাপারে তোমাকে কোনো কথা দিতে পারবো না নন্দিনী। আমি অদৃষ্টবাদী, ভাগ্যের ওপর ভরসা রেখে বসে থাকব।
আমার কথার কোনো জবাব দেবার আগেই লাল পাহাড়গুলোর ওপর থেকে বৃষ্টির আরেক পশলা ঝাপটা এসে আমাকে ও নন্দিনীকে সম্পূর্ণ জবজবে করে ভিজিয়ে দিয়ে গেল। পানির স্রোত বইছে দুজনের গায়ে। নন্দিনীর সিক্ত শরীর আব্রু হারিয়ে কাঁপছে। এর মধ্যে একটা গাড়ির শব্দে আমি উৎকর্ণ হয়ে পেছন ফিরে তাকালাম। আমাদের পেছন দিক থেকে একটা জিপ আসছে। আমি হাত তুলে রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে রইলাম। মুহূর্তের মধ্যে জিপটা এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। একটা লোক জিপের উইন্ডশীল্ডটা হাত দিয়ে মুছে আমাদের দেখেই ইশারায় গাড়িতে উঠতে বলল। গাড়ির কাছে গেলে চালক দ্রুত হাতে দরজা খুলে দিল। খাকি পোশাকপরা একটি টিপরা ড্রাইভার।
আমি বললাম, দয়া করে আমাদের শহরে পৌঁছে দিন। মানবতার খাতিরে।
ভেতরে এসে বসুন।
লোকটা বাংলা জানে।
আমরা জিপে উঠে দেখি সৈনিকদের ময়লা কাপড়ের একটা বড় গাটরি ছাড়া জিপে অন্য কোনো আরোহী নেই। আমি ও নন্দিনী ভেজা শরীরে চাপাচাপি করে ড্রাইভারের পাশের সীটটায় বসলাম। লোকটা একবার আমাদের দেখে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, আমাদের সুবেদার শয়তানটার সাথে কেন তর্ক করতে গেলেন? ওটাতো একটা আস্ত হারামির বাচ্চা।
আমরা তো কোনো তর্ক করি নি তিনিই আমাদের যা তা বলে তাড়িয়ে দিলেন। আমার স্বামী মুসলমান এবং আমি হিন্দু ব্রাহ্মণের কন্যা হয়ে মুসলমান স্বামী গ্রহণ করেছি এই অপরাধে আমাকে অপমানের চূড়ান্ত করলেন।
নন্দিনী জবাব দিল। বৃষ্টি আর গাড়ির ঝাঁকুনিতেও লোকটা কথাগুলো বুঝতে পারল বলেই মনে হল। অকস্মাৎ লোকটা গাড়ি কাঁপিয়ে হেসে উঠে নন্দিনীর দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল, মুসলমানদের ওপর ঐ বামুনবেটার খুব ঝাল। ওর বোনতো এখানকার এক মুসলিম যুবককে বিয়ে করে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছে। ছেলেটি সি. পি. এম করে। এখানকার ইব্রাহিমপুরের দেওয়ানদের ছেলে। খুব উঁচু ঘর। মেয়েটিও ডাক্তার, আমাদের সুবেদার সাহেবের মেজ বোন।
কথাগুলো বলে লোকটা হেসে আমার দিকে ফিরল, আগরতলা জয়বাংলা অফিসে যাবেন?
হ্যাঁ। আমার বোনজামাই এখানকার শরণার্থীর একজন কর্মকর্তা। আমরা জানি না তার বাসা কোথায়? এখন আমাদের অফিসে নামিয়ে দিলেও চলবে। আমরা বাসার ঠিকানা নিয়ে পরে সেখানে যাব।
আমার কথায় ড্রাইভারটি দয়ালু গলায় বলল, এখানকার জয়বাংলার লোকদের সেক্রেটারি মশায়ের বাসা আমি চিনি। প্রায়ই সেখানে আমাদের কর্তাব্যক্তিদের নামাতে যাই। ভদ্রলোকের নাম জানি না, আন্দাজ করি তিনিই আপনার আত্মীয় হবেন। চান তো সেখানেও পৌঁছে দিতে পারি। পরে আমি লন্ড্রিতে কাপড় ধোলাইয়ের জন্য যাব।
আমি বললাম, দয়া করে সেখানেই পৌঁছে দিন।
সেক্রেটারির বাংলার গেটের সামনে যখন জীপটা এসে থামল তখন বৃষ্টি ধরে এসেছে। গেটের দুপাশ থেকে দুজন সশস্ত্র সেন্ট্রি এসে ড্রাইভারকে আমাদের পরিচয় জিজ্ঞেস করলে ড্রাইভার আমার দিকে ইঙ্গিত করে বলল, এরা সেক্রেটারি মশায়ের আত্মীয়। আজই বর্ডার পার হয়ে এসেছে। সঙ্গে জেনানা আছে।
একজন সেন্ট্রি গাড়ির ভেতর মুখ বাড়িয়ে নন্দিনীকে দেখল। আমার দিকে ফিরে বলল, আপলোক কাঁহাসে আয়া?
আমি বললাম, ঢাকা সে।
আপ দোনোকা পাস কুছ হাতিয়ার হ্যায়?
জি নেহি।
গাড়ি সে নিকাল আইয়ে।
আমি ও নন্দিনী গাড়ি থেকে রাস্তায় নেমে পাশাপাশি দাঁড়ালে সেন্ট্রি দুজন আপদমস্তক আমাদের পরখ করে বলল, অব অন্দর যা সেকতে। যাইয়ে।
আমরা গেট পার হয়ে ভেতরে রওনা হলাম। বিরাট ফাঁকা জায়গা ও বাগান নিয়ে একতলা সাদাবাড়ি। বেলা তখন কটা বাজে আকাশের মেঘলা মেজাজের জন্য আন্দাজ করা না গেলেও দুপুর যে গড়িয়ে যায় নি তা অনুভব করা যায়। রাস্তার দুপাশে গেঁদাফুলের ঝাড় হলুদ পাপড়ির ভারে নুয়ে আছে। পরিবেশটাকে কোলাহল মুখর এলাকা বলে মনে হল না। বাড়িটাতেও মানুষজনের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। তবে একটু আগের বৃষ্টির ভেজা ভাবটা ঘাসে, বাগানের ফুলের কেয়ারিতে লেগে আছে। একটা অচেনা, জলসিক্ত আবহাওয়ার গন্ধে পরিবেশটা নিমজ্জিত। আমরা যে বহু কষ্টে, রক্ত, উদ্বেগ, ইজ্জত ও প্রাণহানির বদৌলতে গন্তব্যে এসে পৌঁছেছি সে অনুভূতি একটুও ছিল না। আমরা উভয়েই ধীরে পা ফেলে এগোচ্ছিলাম। তবে নন্দিনীর আগে থেকেই হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল। এখন তার পা ফেলাকে এমন নিষ্প্রাণ মনে হচ্ছিল, আমি তার হাত ধরলাম, হাঁটতে কী কষ্ট হচ্ছে নন্দিনী?
না তো।
তবে কী এমন ভাবছ?
কিছু ভাবছি না। আমার এই দশার কথা এদের কাছে বলতে হবে বলে লজ্জা পাচ্ছি।
বলেই নন্দিনী ফুঁপিয়ে উঠে আমাকে জড়িয়ে ধরে পথের ওপর দাঁড়িয়ে পড়ল।