আনিস না বলাতে মেয়ে দুটি একসাথে আর্তনাদ করে উঠেছিল। না, তাদের নিতেই হবে। তাদের যুক্তি হল তাদের কোনো আশ্রয় নেই। নারায়ণপুর বাজারে একটা খোলা চালার নিচে তারা দেড়টা মাস কাটিয়েছে। এখানকার হিন্দুরা অনেক আগেই অর্থাৎ ঢাকায় ২৫শে মার্চের ঘটনার পর দিন থেকেই বর্ডার পার হবার জন্য সীমান্তের দিকে ছুটছে। শিক্ষয়িত্রী সীমা ও নন্দিনী শুধু যেতে পারে নি। কারণ তারা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ভরসা রেখেছিল যে অজয় ঢাকা থেকে নিরাপদে ফিরে আসবে। কিন্তু ভৈরবের তরুণ ব্যবসায়ী ও আড়তদার অজয় চক্রবর্তী যখন মে মাসের সাত তারিখেও ফিরল না, তখন সীমা ও নন্দিনী আশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হল। এদিকে ভৈরব থেকে ক্রমাগত উদ্বেগজনক খবর আসছিল যে হানাদাররা নারায়ণপুর বাজারেও হানা দিতে পারে। আর সীমাদের চেনাশোনা যুবকগণ যারা ভৈরবের আশপাশ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসগুলো থেকে এই নিরাপদ অঞ্চলে এসে জুটেছিল তারাও একে একে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে কিংবা অস্ত্রের ট্রেনিং নিতে আগরতলা পাড়ি জমাতে লাগল। এ অবস্থায় হতোদ্যম একজন মেয়ে স্কুলের শিক্ষয়িত্রী ও তার কলেজে পড়া বোন আর কতদিন এখানে স্বামী ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করতে পারে?
আমি মেয়ে দুটোর কাতরতা দেখে বিব্রত হয়ে আনিসকে বললাম, ভাই, এদের নাও। আমি বরং পরের সপ্তাহে তোমার জন্য অপেক্ষা করব। আমি তো মোটামুটি নিরাপদ আশ্রয়েই আছি। আর স্থানীয় ছাত্ররাই আমাকে দেখাশোনা করছে। আমি বরং আমার স্ত্রীর জন্য আর কয়েকটা দিন এখানেই অপেক্ষা করি। তারও তো কোনো খবর পাচ্ছি না। অথচ সে আমার এখানে এসে পৌঁছার দুদিন আগেই আমার ছোটো ভাইয়ের সাথে ঢাকা থেকে রওয়ানা হয়েছে। হানাদার বাহিনী ভৈরব দখলের অন্তত দুদিন আগেই আমার স্ত্রী হামিদার ভৈরব বাজারে আমার ছোটো বোনের বাসায় এসে পৌঁছার কথা। যদিও আমার স্ত্রীর একান্ত ইচ্ছে ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আমাদের বাড়িতে এসেই থাকবে। সেও শিক্ষিকা। চিন্তাভাবনাও সাদামাটা। তার ধারণাটা ছিল পঁচিশে মার্চের ঘটনাটা একটু বাড়াবাড়ি হলেও, সাময়িক। শেখ মুজিবের সাথে ইয়াহিয়া খানের শেষ পর্যন্ত সমঝোতার ব্যাপারে হামিদার তেমন সন্দহ ছিল না। যেমন ছিল না আমারও। কিন্তু সবকিছু গোলমাল হয়ে গেল যখন বাঙালিরা তাদের জাতীয় চরিত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত পথে পা বাড়াল। অর্থাৎ পাকিস্তানী সামরিক সিদ্ধান্তের বিপরীতে নিজেরাও সামরিক সিন্ধান্ত নিয়ে বসল।
হামিদা একদিন আগে রওনা হয়েও ভৈরব বা পরিচিত আত্মীয় স্বজনের বাসায় যখন এসে পৌঁছাল না তখন স্বভাবতই আমার মনে উৎকণ্ঠার তুফান বইতে লাগল। এর মধ্যে একবার একটা উড়ো খবর পেলাম। একজন তরুণ গায়ক এসে বললো, স্যার, আমি আর্টস কাউন্সিলের স্টাফ আর্টিষ্ট। আপনার ভাই ও স্ত্রীর খবর আমি জানি। তারা ইণ্ডিয়ায় চলে গেছে। ঢাকা থেকে তারা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গিয়েছিল। কিন্তু শহরটা পাকিস্তানীদের দখলে চলে যাওয়ায় তারা ভৈরবে আসতে চেয়েছিল। যখন জানল যে, ভৈরব ও আশুগঞ্জের পতন হয়েছে তখন একদল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের সাথে আপনার স্ত্রী সীমান্ত পার হয়ে গেছে।
ছেলেটিকে আমি আর্টস কাউন্সিলের লাইব্রেরিতে মাঝে মধ্যে দেখেছি এতক্ষণে মনে পড়ল। আমি বললাম, তুমি জানলে কি করে আমার স্ত্রী ইণ্ডিয়ায় পালাতে পেরেছে? তুমি কি আমার স্ত্রীকে চেনো?
ছেলেটি বলল, বারে, আপনি আমাদের লাইব্রেরিয়ান। আমি প্রায়ই সঙ্গীত বিষয়ক বইপত্রের জন্য আপনাকে বিরক্ত করে থাকি। সেখানে আপনার কাছে আপনার ম্যাডামকে আসতে দেখি না বুঝি? আপনি এখন সম্ভবত আমাকে ঠিকমত রিকগনাইজ করতে পারছেন না। তাছাড়া আপনার ভাই আরিফও তো আমার ক্লাসফ্রেণ্ড। আমরা অন্নদা স্কুলের ছাত্র। আমিও তো কাজীপাড়ারই ছেলে।
এবার ছেলেটিকে আমি খানিকটা চিনতে পারলাম। সেও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছেলে বলেই তার বক্তব্যে আমার উদ্বেগ কেটে গেল। তাছাড়া আমি আর্টস কাউন্সিলের গ্রন্থাগারিক আর সে সেখানকার স্টাফ আর্টিষ্ট। প্রায়শই হয়তো দেখা সাক্ষাৎ ঘটে। তবে আমার পেশাগত অন্যমনস্কতার দরুণ আমি বোধহয় ছেলেটির প্রতি তেমন মনযোগী ছিলাম না। এখন তার দিকে ভাল করে তাকালাম, তুমি কি ভাল করে জানো, আমার স্ত্রী বর্ডার ক্রস করেছে?
হ্যাঁ জানি। রামরাইলের ব্রীজে মুক্তিযোদ্ধারা শেষ প্রতিরোধ বাঁধিয়েছিল। কিন্ত টেকেনি। এসময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে সব শহরবাসী ইণ্ডিয়ার দিকে পালিয়ে যায়। ঐ পালানো লোকদের মধ্যে আমি ও ভাবি ছিলাম। আমরা সিঙ্গারবিলের দিক দিয়ে বর্ডার ক্রস করার চেষ্টা করেছিলাম। আমরা দুজনের গ্রুপ করে করে হানাদারদের চোখ এড়িয়ে একটা পাহাড়ের টিলায় উঠে যাচ্ছিলাম। টিলার ওপাশেই ভারত। প্রথম গ্রুপেই ছিলেন আপনার স্ত্রী। তখন আমার ভাই আরিফকে আর দেখি নি। এরা টিলায় উঠে নিরাপত্তা সংকেতও পাঠিয়েছিল। এরপর এরা অদৃশ্য হয়ে যায়। অর্থাৎ ভারত বর্ডারের ভেতরে চলে গেলে আমরা আরও দুইজন যখন প্রস্তুতি নিচ্ছি তখুনি শুরু হল হানাদারদের গুলী। আমি হলপ করে বলতে পারি আপনার স্ত্রী নিরাপদে ভারতের মাটিতে পা দিয়েছেন। তবে তিনি এখনও সেখানে আছেন কিনা, না আবার দেশের ভেতর ফিরে এসেছে, তা আমি জানি না। ছাত্র ও শিক্ষকেরা তো আবার দেশের ভেতর ফিরে এসে মুক্তিযুদ্ধের খুঁটিনাটি কাজ শুরু করেছে। আপনি এদের জন্য আরও কয়েকটি দিন অপেক্ষা করে দেখুন। যারাই আগরতলা থেকে দেশের ভেতরে এ্যাকশানে আসছে তাদের সকলেই তো নারায়ণপুর, রায়পুর ইত্যাদি এলাকায় এসে জমা হচ্ছে। এখানেই ঢাকা থেকে পালিয়ে আসা রাজনৈতিক ক্যাডাররা বেশি জমা হয়েছে। আপনার ভাইও আসবেন।