চাই নন্দিনী। সমস্ত অন্তর থেকে চাই। তোমাকে ছেড়ে এক মুহূর্তও থাকতে চাই না।
তাহলে তোমার স্ত্রীর সাথে সাক্ষাতের স্বাভাবিকতাও আমাদের মনে রেখেই এগোতে হবে। অর্থাৎ তোমাকে তোমার প্রিয়জনের কাছে ছেড়ে যাওয়ার বিচ্ছেদ। আমার সম্বন্ধে তখন আর একটুও না ভাবা। রাজি?
পথের ওপর থমকে দাঁড়িয়ে নন্দিনী আমার জবাব চাইল। পথে কোনো লোকজন বা যানবাহন নেই। প্রশস্ত পাহাড়ি পথ। চাকার ক্ষতে ভর্তি। দুদিকে ছোটো লাল মাটির পাহাড়ের সারি। পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে তরুণ কাঁঠালের অসংখ্য চারা। বৃষ্টির পানিতে পথ ও চাকার গর্তে পানি জমে আছে। পথও তেমন পিছল নয়। কোনোকালে সম্ভবত পথের ওপর কাঁকর বিছানো ছিল। এখন তা মাটির সাথে মেশামেশি হয়ে যাওয়ায় কাদামাটিতে পা পিছলে যাওয়ার সম্ভাবনাকে রহিত করেছে। পথের একপাশে একটা মাইল পোস্টে লেখা, আগরতলা-৭ কিঃ মিঃ।
আমি কোনো জবাব না দিয়ে নন্দিনীর ডান হাতটা নিজের মুঠোর মধ্যে তুলে নিলাম। নন্দিনী আমার মুখের দিকে কতক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল, আমি তোমার অবস্থাটা বুঝতে পারছি। একজন কবির জন্য এর চেয়ে বিব্রতকর অবস্থা আর কী হতে পারে? তবে আমিও মিথ্যে বলার বা কোনো কিছু গোপন রাখার পক্ষপাতি নই। আমি তোমাকে ভালবাসি। তোমার স্ত্রী অনুপস্থিত জেনেই আমার মন লুব্ধ হয়ে উঠেছে। এ অন্যায়, এ পাপ জেনেও আমার মন বশ মানছে না। কেন মানছে না আমি জানি না। তাছাড়া গত কয়দিন আমার ওপর যা ঘটেছে তাতে তো আমার কোনো ভবিষ্যৎ নেই। আমার পক্ষে আগের নন্দিনী হয়ে যাওয়াও অসম্ভব। আমার অসহায়তার সাক্ষী তুমি। তুমি আমার অবলম্বন, তুমি কবি। তখন ইচ্ছে করলে তুমি আমাকে পথে ফেলে দিয়ে পালিয়ে আসতে পারতে। তা তুমি পার নি। আমি নারী বলেই পালিয়ে আসতে পার নি এটা আমি বিশ্বাস করতে পারব না। বরং একজন বিপদগ্রস্ত, অসহায় যুবতীকে পশুর হাতে ছেড়ে যাওয়া তোমার পক্ষে সম্ভব হয় নি বলেই নিজের জীবনরক্ষার স্বার্থপরতা তোমাতে ছিল না। আমার জীবনে অতীতে কোনো প্রেমের অভিজ্ঞতা না থাকলেও, আমি বলতে পারি এমন পুরুষকেই মেয়েরা বিশেষ করে কুমারী মেয়েরা প্রেমের জন্য বিনাশর্তে নির্বাচন করে। এমন কী পুরুষটি অন্যের স্বামী হলেও।
আমাকে কী তুমি বিনাশর্তে নির্বাচন করেছ নন্দিনী?
আমার মুঠোয় ধরে থাকা নন্দিনীর হাতটায় চাপ দিয়ে বেশ আবেগকম্পিত গলায় আমি নন্দিনীর স্বীকৃতি পেতে চাইলাম।
বিনাশর্তে অবশ্যি নয়। তোমার স্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ না হওয়া পর্যন্ত।
আমার স্ত্রীর সাথে দেখা হলে তুমি কী করবে নন্দিনী?
তার আগে বল তুমি কী করবে?
এই প্রথম আমি নন্দিনীর হাসি দেখলাম।
যেন কিছুই ঘটে নি নন্দিনীর হাসির মধ্যে তেমনি একটা ঠোঁটচাপা প্রশ্নবোধক কৌতূহলী হাসির ছটা।
গত তিনদিন তিনরাতের সমস্ত ঘটনা, মৃত্যু, উদ্বেগ ও পলায়নের দৃশ্যগুলো আমার চোখে মুহূর্তের মধ্যে ভাসতে লাগল। এর মধ্যে গভীর দুর্ভাবনার রেখা ছাড়া আমি নন্দিনীর চেহারায় অন্য কোনো আশার চিহ্ন দেখি নি। বর্ডারটা পার হওয়ার পরই নন্দিনী যেন একটা কিশোরীর মতো পাল্টে গেছে। তার দেহমনে একটা নির্ভাবনা খেলা করছে। অথচ বর্ডার পার হয়ে আমি মৃত্যুর ভয় থেকে মুক্ত হয়েও কেন জানি ভয়শূন্য কিংবা সন্দেহমুক্ত হতে পারছি না। আমি বললাম, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না আমি কী করব।
আমি জানি তুমি কী করবে। নিরপরাধ নির্দোষ মহিলাটির সামনে গেলেই আমার যুক্তিহীন প্রেমের অসারতা তুমি টের পাবে। বেশি ভালো মানুষী করে আমার অসহায়তার কথা বলে তোমার স্ত্রীকে বুঝিয়ে আমাকেও তোমাদের আশ্রয়ে রাখতে চাইবে। তোমার স্ত্রী ও বোন এগিয়ে এসে বলবে, এই বিপদে আপনি কোথায় যাবেন? আমাদের সাথেই থাকুন। একজন বাড়তি মানুষে আমাদের কী অসুবিধা হবে। বরং আপনি থাকলে এদেশে আমাদের উপকারই হবে। এখানকার সামাজিক রীতিনীতিতে আমরা কিছুই জানি না। আপনি আমাদের শিখিয়ে দেবেন যাতে আমরা এদেশের সমাজে মিশতে পারি। আমি শেষ পর্যন্ত থেকে গেলে তুমি হয় তোমার স্ত্রীর ন্যায়সঙ্গত ভালবাসায় তৃপ্ত হয়ে আমাকে একটা আপদ ভাবতে শুরু করবে কিংবা আমার প্রতি অবৈধ প্রেমের আকর্ষণে স্ত্রীকে অবজ্ঞা করতে গিয়ে সংসারটাই ভেঙে ফেলবে। আমিও তোমার প্রতি অন্যায় ভালবাসা ত্যাগ করতে পারব না। এই ঘটবে।
নন্দিনীর কথাগুলো ভারী পাথরের টুকরোর মত, যেন আমার বুকের ওপর ঝরে পড়ল। আমি নন্দিনীর হাত ছেড়ে দিয়ে পথের দুই দিকে নিরুপায়ের মতো একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিলাম। না, আমাদের আশেপাশে দৃশ্য-অদৃশ্য সাহায্যকারী কেউ নেই। শুধু ছোটো পাহাড়গুলোর ওপর থেকে একটা হালকা বৃষ্টির ঝাপটা এসে আমাদের এক পশলা পানিতে ভিজিয়ে দিতে লাগল।
আমি ভাবলাম, নন্দিনী তুমি এতকথাও জানো? আমি কিন্তু তোমাকে একজন কিশোরী বলেই অনুমান করেছিলাম। এখন দেখছি, অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনার অসাধারণ অন্তরদৃষ্টি আছে তোমার। তুমি একজন বয়স্কা মহিলার মতো কথাবার্তা বলছ। এত ভবিষ্যৎ জ্ঞান কোথায় পেলে? আমার স্ত্রীকে আগরতলা গেলেই পাবো এমন তো নাও হতে পারে। আমি একটি মাত্র অপরিচিত ছেলের মুখে শুনেছি সে বর্ডার পার হয়ে এসেছে। এটাতো সত্য নাও হতে পারে। সে হয়তো আমাদের দেশের ভিতরেই কোথাও আশ্রয় নিয়েছে। আগের থেকেই দুর্ভাবনায় থাকা কী উচিত হচ্ছে।