খাওয়া হয়ে গেলে সেপাইরা আমাদের দুজনকেই তাদের সুবেদারের ঘরে নিয়ে গেল। ভদ্রলোক বাঙালি। ঢোকা মাত্রই বললেন, বসুন। আপনারা ঢাকা থেকে এসেছেন?
আমি বললাম, হ্যাঁ।
এখানে আপনাদের আশ্রয় দিতে পারে এমন কোনো পরিচিত কেউ কিংবা আত্মীয়-স্বজন আছে?
আছে। বললাম আমি।
তাদের নাম ঠিকানা জানা থাকলে বলুন।
নাম হোসেন তৌফিক ইমাম। ঠিকানা খুঁজে নিতে হবে। আমার ঠিক জানা নেই।
তিনি কী আপনার বন্ধু?
আমার বোন জামাই।
তিনিও ঢাকা থেকে এসেছেন?
না, তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক। সম্ভবত সেখান থেকেই পালিয়ে এসেছেন।
আমার জবাব শুনে সুবেদার ভদ্রলোক তার নাম লেখার রেজিস্ট্রি থেকে মুখ তুলে একবার আমার দিকে তাকালেন।
এবার বলুন আপনার নাম ও পেশা?
সৈয়দ হাদী মীর। লাইব্রেরিয়ান।
সরকারি কর্মচারী?
হ্যাঁ।
বয়েস কত?
বত্রিশ।
আপনারা উভয়ে কী স্বামী স্ত্রী?
আমি জবাব দেবার আগেই নন্দিনী বলল, হ্যাঁ।
ভদ্রলোক আবার মুখ তুলে আমার ও নন্দিনীর দিকে তাকালেন। সরাসরি নন্দিনীকেই প্রশ্ন করলেন, আপনার নাম বলুন?
নন্দিনী একটুও দ্বিধা না করে জবাব দিল, নন্দিনী ভট্টাচার্য।
আপনাদের কী কোর্ট মেরেজ?
না, কোর্ট মেরেজ হবে কেন আমাদের আনুষ্ঠানিক সামাজিক বিয়ে হয়েছে।
আপনি ধর্মান্তর গ্রহণ করে বিয়ে করেছেন?
আমার কোনো ধর্ম ছিল না বলে ধর্মান্তরের প্রয়োজন ছিল না।
নন্দিনী নির্দ্বিধায় মিথ্যে কথা বলে যাচ্ছে। ভদ্রলোক হেসে বললেন, আমার কৌতূহল দেখে রাগ করবেন না। আজকাল ভারতে অহরহই অসবর্ণ বিয়ে হচ্ছে। পাকিস্তানেও যে জাতপাতের বালাই ছিল না এটা জানতাম না। আমিও ব্রাহ্মণ। বলতে দ্বিধা নেই একজন ব্রাহ্মণ কন্যা মুসলমানকে বিয়ে করেছে শুনলে মুখে থু থু দিতে ইচ্ছে করে।
ভদ্রলোকের তীক্ষ্ণ শ্লেষটা আমার গায়ে তীরের মতো বিদ্ধ হল। আমি রেগে গিয়ে কী যেন একটা জবাব দিতে চাইলাম। কিন্তু নন্দিনী আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, তুমি চুপ করো।
এ আকস্মিক অযাচিত কথোপকথনের মুহূর্তেও নন্দিনী তার দেমাগ হারায় নি। সে আমাকে তুমি সম্বোধন করে সুবেদারকে নিশ্চিত করল আমরা স্বামী-স্ত্রী। তারপর সুবেদারের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার থুথু দেয়ার ইচ্ছেটা একটু বেশি প্রবল মনে হচ্ছে। অব্রাহ্মণ পুরুষ গ্রহণকারী ব্রাহ্মণ কন্যার সংখ্যা এই মহাভারতে এত অধিক যে সবার মুখে থুথু দিতে গেলে আপনার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাবে। কতজনকে থুথু দেবেন? আমার দেশে আপনার মতো একজন ধর্ম মর্যাদাবোধ সম্পন্ন ব্রাহ্মণ সন্তান পেলে আমি তার গলায়ই মালা দিতাম। পাইনি বলেই এই ম্লেচ্ছের গলায় মালা দিয়েছি। এখন আমার মুখে থুথু না দিয়ে দয়া করে আমরা যেখানে যাবো সেখানে পাঠিয়ে দিন।
নন্দিনী তার কথাগুলো এমন গুছিয়ে বলল যে আমিও চমকে তার দিকে তাকালাম। উদাসীন তীক্ষ্ণ গ্রীবাভঙ্গি উন্নত করে সে সুবেদারের দিকে তাকিয়ে আছে। সুবেদার আমার দিকে তাকিয়ে বলল, শহরে পৌঁছার ব্যাপারে আমি কোনো সাহায্য করতে পারব না। আগরতলা এখান থেকে পাঁচ মাইলের পথ। হেঁটে এসেছেন, হেঁটে চলে যান।
আমি ও নন্দিনী কথা না বাড়িয়ে সুবেদারের ঘর থেকে সোজা রাস্তায় এসে উঠলাম। আমি জানি নন্দিনীর হাঁটার ক্ষমতা নেই। রাস্তাটাও জনশূন্য। কিন্তু নন্দিনী কী একটা সাহসের বলে যেন আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, হেঁটেই যাব। তোমার হাঁটতে অসুবিধা না হলে আর দাঁড়িয়ে থেকো না।
আমি নন্দিনীর পেছনে হাঁটা শুরু করেই বললাম, নন্দিনী তুমি আমাকে এখনও তুমি বলছ।
ভালো না লাগলে আপনি বলব।
না না আমি সে কথা বলছি না নন্দিনী। বরং এ ডাকটা আমার খুব আন্তরিক বলেই মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে হঠাৎ বিপদগ্রস্ত হয়ে ডাকা না। এ ডাকা আমার প্রাপ্য বলেই তুমি ডাকছ। লোক চক্ষুকে ফাঁকি দেয়ার জন্যেও নয়। পরিণাম কী হবে তা আমি জানি না। তবে আমি তোমাকে ছাড়তে পারব না।
তুমি তোমার স্ত্রীর কথা ভেবে ভয় পাচ্ছো।
আমি বুঝলাম নন্দিনী আমার মানসিক অবস্থাটা ঠিকমতো উপলব্ধি করেই কথা বলছে। আমার পক্ষ থেকে কোনো জবাব না পেয়ে নন্দিনী আবার বলল, তোমার স্ত্রীর সাথে দেখা হলে আমি আবার তোমাকে আপনি বলে ডাকব। যতক্ষণ তার সাথে তোমার সাক্ষাৎ না হবে ততক্ষণ আমি তোমার স্ত্রী। আমার সাথে স্ত্রীর মতোই আচরণ করবে। আমিও স্ত্রীর কাছে প্রাপ্য সবকিছুই তোমাকে দেব। কেন দেব না? আমার আর কী আছে? সতীত্ব কুমারীত্ব কিছুই তো আমার রইল না। এই যুদ্ধে সব লুট হয়ে গেছে। তোমার সামনেই সব ঘটেছে। আমরা কেউ আমাদের ক্ষতির জন্যে দায়ী নই। এই কথা তো তুমিই সীমাদিকে বলেছিলে। আমি আর আমার পরিণাম নিয়ে চিন্তা করব না। ঈশ্বর যদি মঙ্গলময় হয়ে থাকেন তবে তিনি আমার জন্য মঙ্গলই রাখবেন।
আমি বললাম, নন্দিনী, আমি অত কথা ভাবতে পারছি না। আমার ভয় লাগছে, একথাটাই শুধু বলছিলাম।
আসলে তুমি তোমার বৌয়ের সাথে সাক্ষাতের ভয়ে অস্থির হয়ে পড়েছ। ভাবছো দৈবাৎ যদি তোমার বোনের বাসায় গিয়ে দেখতে পাও তোমার স্ত্রীও সেখানে আছে? তবে আমার কী গতি হবে? আমার সম্বন্ধে কী বলবেন। ভয় নেই যা বলতে হয় আমিই বলব। তোমার বৌ সেখানে থাকলে আমিই তাকে বুঝিয়ে বলব তুমি কিভাবে আমাকে বাঁচিয়ে এতদূর নিয়ে এসেছ। তারপর আমি আমার পথ দেখব। কত মেয়ে নিঃসঙ্গ অবস্থায় দেশ ছেড়ে এদিকে আসে নি? তারা তো আর জলে পড়ে যায় নি। তাদের মতো আমিও ঠিকই নিজের অবস্থা করে ফেলব। আমি ভাবছি তোমার বোন ভগ্নিপতি আত্মীয়দের মধ্যে গিয়ে এই মুহূর্তে কী বলব? তুমি বা কী বলবে? যদি তোমার স্ত্রীর অবর্তমানে আমরা একই সাথে থাকতে চাই। বলো তুমি চাও না?