বেশ কিছুক্ষণ আমরা টিলাটার ওপর বসে থাকলাম। এখন অবশ্য নন্দিনীর কান্না থেমেছে। তবে উদাস দৃষ্টিতে উদ্দেশ্যহীন দিগন্তের দিকে সে কী যেন দেখছে। হঠাৎ আমার মনে হল আমরা উভয়েই অত্যন্ত ক্ষুধার্ত। গত দুদিন ধরে আমরা কিছু খাই নি। ঘটনার উত্তেজনায় আমরা যে আমাদের ক্ষুধাপিপাসাও ভুলে গেছি এটা টের পাওয়া মাত্র আমার পেট মোচড় দিতে লাগল। আমি নন্দিনীকে এক রকম জোর করেই ঠেলে দিয়ে বললাম, ওঠো নন্দিনী, চলো নিচের দিকে যাই। আমার খুব ভুখ লেগেছে।
নন্দিনী নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ালো। আমরা নিচের দিকে নামতে লাগলাম।
.
অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা বস্তিটার কাছে চলে এলাম। দূর থেকে জায়গাটাকে আমি বামুটিয়া বাজার বলে ভেবেছিলাম। কিন্তু কাছে এসে মনে হল এটা একটা ফাঁড়ি। দূর থেকে মানুষজন আছে কিনা বোঝা না গেলেও এখানে এগিয়ে বুঝলাম আমাদের লক্ষ্য করে পাহাড়ের ফাঁকে গাছের আড়ালে রাইফেল উঁচানো পাহারাদার রয়েছে। আমরা বস্তিটার সামনে এসে দাঁড়ানো মাত্র কোত্থেকে যেন কয়েকজন সেন্ট্রি এসে আমাদের ঘিরে ফেলল। সবার হাতেই স্টেনগান। সেন্ট্রিদের চেহারা দেখে বুঝলাম এরা স্থানীয় ত্রিপুরা উপজাতির যুবক। এরা কিছু জিজ্ঞেস করবার আগেই আমি বললাম, আমরা ঢাকা থেকে এসেছি। আমরা সামান্য খাবার ও বিশ্রাম চাই।
একজন সেপাই নন্দিনীর কাদামাখা ক্লান্ত দেহের দিতে তাকিয়ে বলল, মনে হয় এই মহিলার ওপর জুলুম হয়েছে?
আমরা একথার কোনো জবাব দিলাম না। নন্দিনী মাটির দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকলেও একটা হাত বাড়িয়ে আমার কাঁধ চেপে ধরল।
অন্য একজন টিপরা সেপাই বলল, আপনারা এখন কোথায় যেতে চান?
আমি বললাম, বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের যে কোনো কর্মকর্তার কাছে আমাদের পৌঁছে দিন।
তারা এখান থেকে মাইল পাঁচে দূরে আগরতলায় আছে।
আমি বললাম, সেখানেই যাব। তার আগে আমাদের চারটে খেতে দিন।
আমার কথায় এমন একটা অনুনয়ের সুর ফুটে উঠল যে সেপাই চারজনই পথ ছেড়ে সরে দাঁড়াল। এদের মধ্যে একজন বলল, চলুন আমার সাথে ক্যাম্পে। সেখানে আপনাদের নাম ঠিকানা লিখে দিতে হবে। সেখানেই চারটে খেয়ে নেবেন। আগরতলায় আপনাদের কোন পরিচিত লোক আছে?
আমি বললাম, আছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিসি যিনি এখানকার জয় বাংলার সেক্রেটারি তিনি আমার ভগ্নিপতি। নাম হোসেন তৌফিক ইমাম। আমরা সেখানেই যাব।
আমার কথায় সেপাই চারজনই সম্ভবত বুঝতে পারল আমরা দুজন গুরুত্বহীন রিফিউজি নই। এদের নেতা যার সাথে এতক্ষণ কথা হচ্ছিল সে বলল, নাম এন্ট্রি করে আমরা জিপে আপনাদের সেখানে পাঠিয়ে দেব। একটু পরেই আমাদের ক্যাম্পের জিপ আগরতলা যাবে। চলুন।
আমরা সেন্ট্রিদের পেছনে চলতে লাগলাম।
একটু পরেই আমরা ক্যাম্পের প্রবেশ পথে এসে পৌঁছলাম। গেটের পাশে একটা সাদা রং-করা বাঁশের মাথায় ভারতীয় পতাকা উড়ছে। নিশানটা দেখেই কেন জানি না আমার দেহ মন এক সাথে চমকে উঠল। আমি ছবিতেই ইতিপূর্বে অশোকচক্র আঁকা এই তিনরঙা পতাকা দেখেছি। কিংবা হয়তো ঢাকার ভারতীয় দূতাবাসের সামনে দিয়ে যেতে এক আধবার এই হিন্দুস্তানী নিশান দেখে থাকবো। এখন ভারতের মাটিতে হঠাৎ এই পতাকা উড়তে দেখে অজানা আশংকা বা অনভ্যাসের কারণে বুকটা দুলে উঠল। আমি নন্দিনীর কানের কাছে মুখটা নিয়ে বললাম, নন্দিনী, এরা নাম এন্ট্রির সময় আমাদের পরস্পরের সম্পর্কের কথা জিজ্ঞেস করলে কী বলবো?
যা বলতে হয় আমি বলবো।
বুঝলাম সীমান্ত অতিক্রমের ফলে নন্দিনীর মধ্যে নিরাপত্তা ও আত্মবিশ্বাস ফিরে এসেছে। নন্দিনীর দৃঢ়তায় আমার খুব ভালো লাগল। আমি হেঁটে যেতে যেতেই তার হাতটা নিজের হাতে তুলে নিলাম। সে একবার মাত্র পলকের জন্য আমার মুখের দিকে চোখ তুলে আবার দৃষ্টি নামিয়ে ক্যাম্পের বারান্দায় এসে উঠল। এটা ভারতীয় সীমান্ত প্রহরীদের একটা ছোটো ফাঁড়ি। সর্বমোট চারটে দরজার ঘর। সবগুলো ঘরের বারান্দাই সিমেন্টে বাঁধানো। সেপাইরা যে যার ডিউটিতে ব্যস্ত। কেউ আমাদের আগমনকে তেমন পাত্তাই দিল না। মনে হয় আমাদের মতো আগন্তুক এ ক্যাম্পে প্রায় প্রত্যহই আসা-যাওয়া করে। পাহারাদার সেন্ট্রিদের নেতা, যার হুকুমে আমরা এসে ঢুকেছি সেই লোকটি একটা লম্বা টুল দেখিয়ে আমাকে ও নন্দিনীকে বসতে ইঙ্গিত করল। আমরা বসলাম। লোকটি সম্ভবত সঙ্গের সেপাইদের আমাদের জন্য কিছু খাবারের আয়োজন করতে বলল। সেপাই তিনজনই আমাদের বারান্দায় রেখে সামনের একটি ঘরে গিয়ে ঢুকল। আর এদের নেতা আমার দিকে ফিরে বললেন, সামনে একটা কুয়ো আছে। ইচ্ছে করলে হাত পা ধুয়ে নিতে পারেন। আপনারা তো কাদায় মাখামাখি হয়ে আছেন!
আমি ও নন্দিনী কুয়োর পাড়ে এসে দাঁড়ালাম। এখানে দুটো বালতিতে পানি তোলাই আছে দেখে আমি একটা মগ এনে নিজেই নন্দিনীর হাত ও পায়ের আঠালো লাল মাটির শুকনো কাদা ভিজিয়ে দিতে লাগলাম। উভয়ে হাতমুখ ধুয়ে এসে দেখি সেপাইরা লম্বা টুলের ওপর আমাদের জন্য গরম মোটা রুটি ও কিছু তরকারি রেখে গেছে। টুলের পাশে একজন সেপাই দাঁড়ানো। আমাদের দেখেই বলল, খা’লো।
আমরা বিনা বাক্য ব্যয়ে তার আদেশ পালনে হাত বাড়িয়ে দিলাম। আমার কাছে রুটি ও তরকারি অমৃতের মতো মজাদার মনে হল। নন্দিনীও খাচ্ছে, তবে আমার মতো গোগ্রাসে নয়। আমি দ্রুত আমার থালায় রাখা তিনটি পুরো গমের রুটি তরকারিসহ একরকম গিলে খেয়ে ফেললাম। সেপাইরা গ্লাসের বদলে দুটি আলাদা ঘটিতে পানি দিয়েছে। আমি ঢকঢক কর একঘাটি পানিও খেলাম। মনে হল বহুকাল বুঝি এমন সুস্বাদ খাদ্য ও পানীয় আমার ভাগ্যে জোটে নি।