নন্দিনী কোনো জবাব দিল না।
নন্দিনী, একটু কষ্ট করে উঠে দাঁড়াও। সামান্য কয়েক গজ পথ পেরিয়ে গেলেই আমরা নিরাপদ হব। নিজের প্রতি একটু ভরসা রেখে উঠে দাঁড়াও নন্দিনী। মনে হচ্ছে শত্রুরা আনিসের দলটাকে শেষ করে দিয়ে এদিকে এগিয়ে আছে। একটু উঠে বস নন্দিনী।
আমার কথায় এক ঝটকায় নন্দিনী উঠে বলল, দিদি?
দিদি আর পৃথিবীতে নেই নন্দিনী।
আমার কথায় হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে নন্দিনী সীমাদির মৃতদেহের দিকে তাকাল।
আমিও আর কোথাও যাব না হাদীদা। ওরা আমাকেও মেরে ফেলুক। আপনি চলে যান। আমার জন্য আর বিপদে পড়বেন না। বলেই নন্দিনী রাস্তার ওপর পড়ে থাকা সীমার দেহটা জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
আমি জানতাম এখন আর এভাবে বসে থাকার উপায় নেই। আমি নন্দিনীর পাশে এসে বসলাম। আমার পেছনে ঝোপের ভেতর থেকে আগের মতোই ঝিঁঝির একটানা শব্দ উঠছে। একটু আগে গুলীর শব্দে ঝোপের ভেতর থেকে এক ধরনের পাখি ঝাঁক বেঁধে উড়ে গিয়েছিল। এখন পাখিগুলোর মাঝ থেকে একটা দুটা দলছাড়া হয়ে আবার ফিরে এসে দারুণ চেঁচামেচি জুড়ে দিয়েছে। গাছের ফাঁক-ফোকর থেকে দুপুরের রোদের টুকরো সীমার স্তব্ধ দেহে ও আমাদের মুখে এসে পড়ল। আমি আবার নন্দিনীকে বোঝাতে চাইলাম, নন্দিনী আমার কথাটা শোনো।
নন্দিনী কান্না থামিয়ে আমার দিকে না ফিরেই চুপ করে থাকল। আমি বললাম, নন্দিনী, আমি কী এখানে তোমাকে এভাবে ফেলে কোথাও যেতে পারি? তোমাকে নিয়েই আমাকে এখান থেকে এগোতে হবে।
আমি যাব না।
বুঝতে চেষ্টা করো নন্দিনী। অবুঝ হয়ো না। আমরা এখন একটা সাংঘাতিক যুদ্ধের মধ্যে আছি। এ যুদ্ধে এখন আমরা মার খেলেও একদিন আমরা জিতবোই। বলল, তখন আজকের এই ঘটনার আমি কী কৈফিয়ৎ দেব? আমরা নিজের বিবেকের কাছেই বা আমার জবাবটা কী হবে?
আমি নন্দিনীর পিঠের ওপর গভীর স্নেহে হাত বুলিয়ে দিলাম। নন্দিনী উঠে বসেই প্রশ্ন করল, আমরা কী দিদিকে এভাবে এখানে ফেলেই চলে যাব?
এছাড়া আমাদের কোনো উপায় নেই নন্দিনী। আর আমরা যাকে এতক্ষণ দিদি বলেছি, এখন তিনি আর আমাদের সাথে নেই নন্দিনী। তিনি এখন এই জগতের সকল হিংস্রতার ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
আমি নন্দিনীর রক্তে ভেজা চটচটে হাতদুটো নিজের হাতের মুঠোর মধ্যে টেনে আনলাম।
আমার দিদি কোনো সৎকারই পাবে না? আমি একথার কোনো জবাব না দিয়ে নন্দিনীকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করতে লাগলাম। এখন সে একটু কাৎ হয়ে নিজের ভর আমার হাতের উপর রেখে উঠে দাঁড়াল। আমি বললাম, আমরা আমাদের দেশের জন্য আত্মোৎসর্গীকৃত বোনের কোনো সৎকার না করেই চলে যাচ্ছি। আল্লাহ নিশ্চয়ই সীমাদিকে অপমানের হাত থেকে বাঁচাবেন।
হঠাৎ সে আমার গলা থেকে হাত নামিয়ে বলল, চলুন।
আমি কথা না বলে নন্দিনীর পেছনে হাঁটা শুরু করলাম। নন্দিনী মুহূর্তের জন্য একবার মাত্র বোনের উপুড় হয়ে থাকা দেহটার দিকে ঘাড় ফিরিয়ে দেখল। শাড়ির খুঁট দিয়ে চোখ চেপে ধরে আবার মুহূর্তের জন্যে দাঁড়াল। কিন্তু এবার আমি তাকে দাঁড়াতে না দিয়ে এক রকম ঠেলা মেরেই বললাম, আর কোনো কথা না নন্দিনী ঐ সামনের উঁচু টিলাটিই আগরতলার সীমানা। ওখানে না পৌঁছে আমরা আর বিশ্রাম বা ফিরে তাকাব না। মনে রেখ এটুকু পথ সাবধানে পার হতে না পারার জন্যই সীমাদিকে আমরা হারালাম।
নন্দিনী কোনো কথা না বলে তার শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে আমার সাথে পা চালিয়ে চলতে লাগল। অল্পক্ষণের মধ্যেই আমরা পাহাড়টার নিচে চলে এলাম। দিন দুপুরেও জায়গাটা আশ্চর্য রকম নিস্তব্ধ। তবে পাহাড়টার গা বেয়ে একটা পায়ে চলার পথ সোজা ওপরের দিকে উঠে গেছে। মুস্কিল হল পথটা লালমাটির ভেজা কাদায় পিচ্ছিল। আমি কোনো মতে পা টিপে উঠতে পারলেও নন্দিনীর পক্ষে তা একেবারেই অসম্ভব মনে হল। রাস্তাটির মুখে এসে আমি নন্দিনীর দিকে তাকালাম। কিন্তু নন্দিনী আমার সন্দেহকে ভ্রূক্ষেপ না করে সোজা পাহাড়ের পথটা বেয়ে খানিকদূর উঠে গেল। খানিক উঠেই পিচ্ছিল লাল কাদায় পা স্থির রাখতে না পেরে সামনের দিকে ঝুঁকে হাত দিয়ে মাটি আঁকড়ে ধীরে ধীরে এগোতে লাগল। আমি বুঝলাম নন্দিনীর মনের জোর বেড়ে গেছে। দেরি না করে আমিও তার পাশে উঠে এলাম।
একটু পরেই আমরা টিলাটার চূড়ায় উঠে এলাম। নন্দিনী কোনোমতে পাহাড়ের চূড়ার সমতলে পৌঁছেই ঘাসের ওপর চিৎ হয়ে চোখ বুজে পড়ে থাকল। আমি এগিয়ে গিয়ে তার পাশে বসলাম। নন্দিনী তার পাশে বসামাত্রই চোখ মেলে একবার আমাকে দেখল, এটা কী ভারতের মাটি?
আমি বললাম, সম্ভবত এ পাহাড়টা ভারতীয় এলাকায়, পাহাড়টার ওপাশে একটা বস্তির মতো দেখতে পাচ্ছি। মনে হচ্ছে ওটাই বামুটিয়া বাজার। আমরা আগরতলায় এসে গেছি নন্দিনী। আর কোনো ভয় নেই।
আমার আশ্বাসে নন্দিনী মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে শিশুর মতো উচ্চস্বরে বিলাপ করতে লাগল। মেয়েরা যেমন মৃত প্রিয়জনের দেহের পাশে লুটিয়ে কাঁদে নন্দিনীর কান্নাটাও সে রকম। সীমাদির দুর্ভাগ্যের বর্ণনা দিয়ে, তার নাম ধরে নন্দিনী বিলাপ করছে। এ ধরনের কান্নার সাথে আমার পরিচয় আছে। আমি নন্দিনীকে থামতে না বলে চুপচাপ বসে রইলাম। আর বিপরীত দিকে তাকিয়ে দেখলাম, যে বস্তি মতন ঘরবাড়িগুলোকে আমি বামুটিয়া বলে ভাবছি সেখানে প্রকৃতপক্ষে কোনো মানুষজন আছে কিনা। একবার মনে হল বস্তির ঘরবাড়িগুলো থেকে যেন আবছা মতন ধোঁয়ার কুণ্ডলী বেরিয়ে আসছে। আবার মনে হল, না, ধোঁয়া দেখাটা আমার চোখের ভুল। মানুষজন থাকলে কাউকে না কাউকে চলাফেলা করতে দেখতাম।